Friday, December 5, 2014

Nasreen Taslima সেদিন বোয়াল মাছ কিনলাম। বোয়াল মাছ হয় আমি খুবই কম কিনেছি জীবনে অথবা প্রথম কিনলাম। খাইনি তা নয়।


সেদিন বোয়াল মাছ কিনলাম। বোয়াল মাছ হয় আমি খুবই কম কিনেছি জীবনে অথবা প্রথম কিনলাম। খাইনি তা নয়। ছোটবেলায় খেয়েছি। বাবা কিনতো। বোয়াল নামটা আমার পছন্দ হত না বলে খেতে তেমন ইচ্ছে করতো না। স্বাদটাও খুব কিছু আহামরি ছিল না। বড়বেলায় তাই আর শখ করে বোয়াল কিনিনি। কিন্তু সেদিন বোয়ালটা কিনলাম সম্ভবত এই কারণে যে ছোটদা কিছুদিন আগে বোয়ালের গল্প বলছিল। বলছিল, সপ্তা-দু'-সপ্তা আগে নাকি দেশের বাড়িতে বোয়াল রান্না হয়েছিল, কারণ বড়দা'র খুব বোয়ালের মাথা খাওয়ার শখ হয়েছিল। খেতে গিয়ে বড়দা চেঁচামেচি করেছে, কী, রান্না ভালো হয়নি। পরদিন আবারও বোয়াল রান্না হল, বড়দা সেদিনও রাগ করলো। বড়দা'র এক কথা, ঝোলটা শুধু ঘন নয়, একটু আঠা আঠাও হতে হবে, নানি রান্না করলে ঠিক যেমন হতো। এখন নানি কী করে রান্না করতো তা বৌদি বা বাড়িতে আর যারা রান্না করে, তাদের জানার কোনও কারণ নেই। আর ঠিক ওরকম আঠা আঠা ঝোল যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ বড়দা ভাত মুখে দেবে না। এর নাম কী? স্মৃতিকাতরতা? পাগলামো? যে নামেই ডাকি না কেন, ভেতরে ভেতরে বুঝি, আমারও হয় এমন। বড়দা রাগ করতে পারে, আবদার করতে পারে, তার বাড়ি ভর্তি লোক। আমার তো সেরকম নয়। গোটা বাড়িতে আমি একা। কুড়ি বছর আগে, দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষজন ছেড়ে, যখন সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিবেশের মধ্যে এসে পড়েছিলাম, আমাকে একা বাজার করতে হতো, একা রান্না করতে হতো, অথচ রান্নাটাই কোনওদিন আমার শেখা হয়নি দেশে। সেই সময় কাঁচা হাতে রান্না করতাম, শুধু লক্ষ্য রাখতাম, মা'র রান্নার মতো হচ্ছে কী না। মা'র রান্নায় যে স্বাদ হতো, আমার রান্নায় সেই স্বাদ না আসা পর্যন্ত নিজের রান্নাকে কোনওদিন ভালো রান্না বলিনি। সেই যে শুরু হয়েছিল, এখনও তাই চলছে। ছোটবোনের বেলাতেও দেখেছি ওই একই, রান্না যদি করে, মা'র মতো রান্না তার করা চাই। আমার চেয়ে ঢের বেশি ও জানে মা'র স্বাদের কাছাকাছি স্বাদ আনতে। ওর বাড়িতে ক'দিন থাকলে ওজন আমার দু'তিন কিলো বাড়বেই। জিভে কী করে এত কাল আগের স্বাদটা লেগে থাকে জানি না। আসলে জিভের ব্যাপার তো নয়, এ মস্তিস্কের ব্যাপার। মস্তিস্কের স্মৃতিকোষগুলোয় কী করে যে সব গাঁথা হয়ে থাকে। বড়দার ওই আঠা আঠা ঝোলের বোয়াল মাছের মাথা খাওয়ার ছেলেমানুষী আবদারকে ঠিক দোষ দিতে পারি না। সেদিন বোয়াল কিনে আমিও তো ঠিক ওই আঠা আঠা ঝোলটাই বানাতে চেষ্টা করেছি।

ছোটবেলায় যে কত রকমের মাছ খেতাম। সব মাছের নাম মনেও নেই। ভালো লাগতো ইলিশ চিংড়ি কই রুই মাগুর খেতে। চিংড়িকে অবশ্য মাছ বলা যাবে না, কিন্তু চিংড়ি মাছ নয়, ভাবলে কেমন যেন দুঃখ লাগে। রুই ছিল তখন মাছের রাজা। এখন যেমন বারোয়ারী হয়ে গেছে, তেমন ছিল না। সত্যি বলতে, গত কয়েক বছর যে মাছকে আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি, সে হলো রুই। কলকাতায় থাকাকালীন রুইএর ওপর এই অনীহাটা আমার জন্ম নিয়েছে। যেদিকে যাই, যেখানে তাকাই, শুধু রুই, রুই আর রুই। খেতে খেতে রুইয়ের স্বাদ একসময় বিচ্ছিরি লাগতে শুরু করলো। মনে হতে লাগলো যেন ঘাস খাচ্ছি। কলকাতায় যদুবাজার, গড়িয়াহাট, আর মানিকতলা থেকে কত রকমের যে মাছ কিনতাম আমি। এত বিচিত্র মাছ দেশের বাজারেও হয়তো দেখিনি। অবশ্য দেশের বাজারে কদিন আর গেছি। আমাদের সময় মেয়েদের মাছের বাজারে যাওয়ার চল ছিল না। মাগুর নামটা যদিও আমার ভালো লাগে না, মুগুর মুগুর লাগে শুনতে, কিন্তু খেতে ভালো লাগতো, বিশেষ করে মা যখন ধনে পাতা আর টমেটো দিয়ে মাছের পাতলা ঝোল করতো। একবার কী একটা কবিতায় আমি মাগুর মাছের নাম উল্লেখ করেছিলাম, তাই নিয়ে কিছু কবি নাক সিঁটকেছিল। কবিতায় মাগুর কেন আসবে, ইলিশ আসতে পারে, চিতল আসতে পারে। মাগুর শব্দটা নাকি কবিতাকে নষ্ট করে দেয়। ওদের কথায় আমি কিন্তু আমার ওই কবিতা থেকে মাগুর মাছ বাদ দিইনি। ভেটকি শব্দটা বড় বিচ্ছিরি লাগতো। কলকাতায় তাই ভেটকি আমি প্রথম প্রথম একেবারেই কিনতাম না। রেস্তোরাঁয় আর বন্ধুদের বাড়িতে খেতে খেতে একসময় টনক নড়লো, বাহ, এ তো বেশ সুস্বাদু মাছ হে। এরপর থেকে ভেটকি কেনা শুরু হলো আমার। এখনও কিনি। কলকাতার লোকেরা, খুব অবাক হতাম, রূপচাঁদা মাছকে কেন পমফ্রেট বলে। ফরাসি ভাষায় আলুভাজাকে পমফ্রেট বলে। পমফ্রেট নামটা কোত্থেকে এলো হদিস করতে গিয়ে দেখলাম, এসেছে প্যামফ্লেট থেকে। পর্তুগিজ ভাষায় কোনও কোনও মাছকে প্যামো বলে। সেই প্যামোটাই সম্ভবত উৎস। পমফ্রেট সমুদ্রের মাছ। সমুদ্রের মাছ, জানি না কেন, নদী আর পুকুরের মাছের মতো সুস্বাদু হয় না। নাকি মিঠেপানির মাছ খেতে খেতে আমাদের জিভটাই মিঠে মিঠে হয়ে গেছে! রূপচাঁদা নামটা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সমুদ্রের মাছ বলেই হয়তো খেতে কখনই খুব ভালো লাগেনি। ঠিক মনে নেই মা কী করে রূপচাঁদা রান্না করতো। ভাজতো বোধহয়। ভাজলে অবশ্য অনেক বিস্বাদ জিনিসেও স্বাদ চলে আসে।
মানি আর না মানি, আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরকে সারা জীবন সঙ্গে নিয়ে বেড়াই। বড় হই, কিন্তু বড় হই না। নানির বাড়িতে পিঁড়ি পেতে বসে বা মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে যে খাবারগুলো খেতাম, সেগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার এখনও। মাটির চুলোয় ফুঁকনি ফুঁকে শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মা যা রান্না করতো, সেই রান্নাই এখন অবধি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না। ‌আজকালকার অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক স্টোভে, ওভেনে, গ্যাসে রান্না করা খাবার খেয়েছি, কিছুই মা'র ওই মাটির চুলোর রান্নাকে ডিঙোতে পারেনি। এ কি মা'কে ভালোবাসি বলে বলি? না, মা'কে কোথায় আর ভালোবাসলাম! মা তো ভালোবাসা না পেতে না পেতেই একদিন চিরকালের জন্য চলে গেল। বড় অভিমান ছিল মা'র। একটা কী ভীষণ দুঃখের জীবনই না কাটিয়েছে মা। আমার বোনটাও। অনেকটা মায়ের মতোই জীবন ওর। বোনটা দেখতে মায়ের মতো নয়, আমি দেখতে অবিকল মা। কিন্তু আমার জীবনটা মায়ের জীবনের চেয়ে অন্যরকম। সংসারে দুঃখ কষ্ট সওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি আমি, কিন্তু মা যেমন নিজেকে বাঁচাতে পারেনি, বোনটাও পারেনি।

মা'র নানারকম গুণ ছিল, কিন্তু মা'র গুণগুলোকে কখনো গুণ বলে মনে হতো না। মা বলেই সম্ভবত। মা'দের আমরা মা বলে মনে করি, ঠিক মানুষ বলে মনে করি না। মা'দের গুণগুলো দেখি, কিন্তু না দেখার মতো করে দেখি। রান্না ছাড়াও নানির অসাধারণ সব গুণ আছে। কিন্তু ক'জন নানিকে সেসব বলেছে, নানির ছেলেমেয়েরা কেউ কি তার প্রশংসা করেছে কখনও! আমার মনে হয় না। মা যে বেঁচে থাকতে তার অজস্র গুণের জন্য একটিও প্রশংসা বাক্য শোনেনি সে আমি জানি। মা না হয় আজ আর নেই। নানি তো আছে। যে নানির রান্না করা বোয়াল মাছের ঝোলের মতো ঝোল না হলে বড়দা বোয়াল মাছ খায় না, সেই নানিকে ক'দিন বড়দা দেখতে গেছে? এক শহরেই তো থাকে! ক'দিন নানির শিয়রের কাছে বসে পুরোনো দিনের গল্প করেছে? সম্ভবত একদিনও নয়। যদি গিয়ে থাকে কখনও, নিজের কোনও স্বার্থে গিয়েছে। নানি হয়তো আর বেশিদিন নেই। দেশ থেকে ফোন এলে বুক কাঁপে এই বুঝি শুনবো নানি আর নেই। আমাদের ছোটবেলাটা নানির বাড়িতে কেটেছে। বড়দাকে যখন জন্ম দিয়েছিল মা, মা তখন অল্প বয়সী কিশোরী বা এক রকম শিশুই। মা'র পক্ষে একা ছেলে বড় করা অসম্ভব ছিল না। নানি সাহায্য করতো। এখন বড়দার সময় নেই নানির কাছে যাওয়ার। আমি যদি দেশে থাকতাম, আমি নিশ্চয়ই নানিকে খুব ঘন ঘন দেখতে যেতাম। মানুষের থাকা আর না থাকার মধ্যে পার্থক্যটা আমি খুব ভালো করে জানি এখন। মা ছিল, মা নেই। বাবা ছিল, বাবাও নেই। পর পর বেশ কিছু খালা মামা, যাদের কাছে ছোটবেলায় মানুষ হয়েছি, চলে গেছে। নানি এখনও আছে। হীরের মতো বেঁচে আছে। যতদিন নানি আছে, তার থাকার উৎসবটা তো হওয়া চাই! সারা জীবন কেবল দিয়েছে নানি, নানিকে দেবার কেউ নেই। মেয়েদের জীবনটা যেন কেবল দিতে দিতে নিঃস্ব হওয়ার জন্যই, নিঃস্ব হতে হতে মরে যাওয়ার জন্যই। যেন কিছু পাওয়ার জন্য নয়। নানির মস্তিস্ক এখনো সতেজ, এখনও স্মৃতিশক্তি ভালো। কিন্তু হলে কী হবে, বাড়ি ভর্তি মানুষ, শুধু নানির ঘরটায় কারও আনাগোনা নেই। সবাই অপেক্ষা করছে নানির মৃত্যুর। মানুষ উদার হতে পারে ঠিক, তার চেয়ে শতগুণ বেশি নিষ্ঠুর হতে পারে।

নির্বাসন আমাকে আমার সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নানির ঋণ শোধ করতে দিচ্ছে না। মা বাবার ঋণও শোধ করতে দেয়নি। যাদের ভালোবাসি, তাদের সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে আমাকে নির্বাসন, আমার সেই শৈশব-কৈশোরের জীবন থেকে লক্ষ যোজন দূরে। যেন ভুলে যাই সব। কিন্তু আমি তো ভুলতে কাউকে পারি না। ছোট যে একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে, সেটাকেও তো আজও ভুলতে পারিনি।

Like · Share

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcom

Website counter

Census 2010

Followers

Blog Archive

Contributors