Sunday, April 24, 2011

প্রচার-মঞ্চে এলেন বড়মা, দৃশ্যতই আপ্লুত তৃণমূল নেত্রী

http://anandabazar-unicode.appspot.com/proxy?p=24south1.htm

প্রচার-মঞ্চে এলেন বড়মা, দৃশ্যতই আপ্লুত তৃণমূল নেত্রী

সীমান্ত মৈত্র • গোবরডাঙা

শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর, গোবরডাঙা এবং হাবরায় তিনটি সভা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত গোবরডাঙা কলেজ মাঠে দুপুর ১টা নাগাদ পৌঁছন তিনি। কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে আসার সময়েও মমতা সংশয়ে ছিলেন সভায় মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানিদেবী তথা বড়মা আসবেন কিনা, তাই নিয়ে। যাত্রাপথে সহকর্মীদের বলেওছিলেন, "এত গরমে উনি কি আসতে পারবেন?" কিন্তু মমতা আসার আগেই মঞ্চে বসেছিলেন অশীতিপর বড়মা। সঙ্গে গাইঘাটা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তথা নিজের ছোটছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর।

দৃশ্যতই অভিভূত মমতা মঞ্চে উঠেই বড়মার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সারেন। বড়মাও মমতার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। বড়মার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক অবশ্য নতুন নয়। রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে ঠাকুরনগরের (এখানেই আছে মতুয়া মহাসঙ্ঘের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি) উন্নয়নে বহু টাকা ব্যয় করেছেন। মতুয়া মেলার সময়ে দিয়েছেন বিশেষ ট্রেন। নিজেও মতুয়া মহাসঙ্ঘের সদস্যপদ নিয়েছেন। মঞ্জুলকে গাইঘাটা আসনে ভোটে দাঁড় করিয়ে রাজনীতির ময়দানে আগেই বড়সড় 'মাস্টারষ্ট্রোক' খেলেছিলেন মমতা। এ দিন মমতা বক্তৃতার শুরুতেই বলেন, "শ্রদ্ধেয় বড়মা এসেছেন। এত গরমে কষ্ট পাচ্ছেন। বেশি ক্ষণ ওঁকে আটকাব না।" মমতা এ কথা বললেও সভার পুরো সময় (প্রায় আধ ঘণ্টা) মঞ্চে ছিলেন বড়মা।

সভায় বড়মার আশীর্বাদ নিচ্ছেন মমতা। —পার্থসারথি নন্দী

বড়মাকে নিয়ে টানাপোড়েনে এক সময় বামপন্থীরাও চেষ্টার কসুর করেনি। বড়মাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের দুই ধর্মগুরু হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের নামে রিসার্চ ফাউণ্ডেশনের জমি দান উপলক্ষে রাজারহাটে বিশাল সভার আয়োজন করেছিল সিপিএম (তার আগেই হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নামে বিশেষ পুরস্কার চালু করেছে রাজ্য সরকার। প্রথম বছর সেই পুরস্কার পেয়েছেন মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণ)। সেই অনুষ্ঠানে বড়মা আসবেন ধরে নিয়ে আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব তথা হিডকোর উদ্যোগে সভাস্থলের কাছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রীতিমতো একখণ্ড গ্রাম তৈরি হয়েছিল। বড়মার থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কুটির। সেই অনুষ্ঠানে আসেননি বড়মা। কিন্তু ছোট ছেলের প্রার্থিপদ ঘোষণার পরে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে প্রচারে বেরোবেন। এ দিন সেই 'কথাই রাখলেন' তিনি।

এ দিন মমতার প্রতিটি সভাতেই ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। চাঁদি ফাটা রোদে মমতার জন্য গোবরডাঙায় হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর হেলিকপ্টার যখন গোবরডাঙার আকাশে চক্কর কাটছে, তখনই শুরু হল তুমুল হর্ষধ্বনি, উলুধ্বনি। মহিলারা শাঁখ বাজাচ্ছিলেন। মতুয়াদের প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র ডাঙ্কা-কাঁসার আওয়াজে তখন কার্যত কান পাতা দায়। হেলিপ্যাড থেকে মঞ্চে হেঁটে আসার পথে মমতাকে দেখতে ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় মঞ্চের পিছনের ইটের পাঁচিল। সভা চলাকালীনও এক সময় ভিড়ের চাপে ব্যারিকেড ভাঙার উপক্রম হয়েছিল। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যায় পুলিশ। মমতা সকলকে শান্ত হতে বলেন। সেই কথায় কাজও হয়।

বিধানসভা ভোটে 'জয়ী হয়ে এসে' প্রথমেই বড়মার আশীর্বাদ নিতে আসবেন বলে এ দিন 'কথা দিয়েছেন' মমতা। সরকার গড়লে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িকে 'ঐতিহাসিক স্থান' হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "গুরুচাঁদের নামে এখানে কলেজ হবে। মায়ের (বড়মা) অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল তৈরি করব। উন্নয়ন করব। প্রচুর মানুষ এখানে কাজ পাবে।" সিপিএমকে তাঁর কটাক্ষ, "ওরা ধর্মকর্ম মানে না। দুর্গাপুজোয় যায় না। ঠাকুরবাড়িতে যায় না। তবে আমি বড়মার কাছে গেলে সিপিএমও দুটো লেজুড় ধরে বড়মার কাছে আসে।"

হাবরায় তৃণমূল প্রার্থী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সমর্থনে এক সভায় মমতা বলেন, "বড়মা এসে আশীর্বাদ করায় আমরা কৃতজ্ঞ।" জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, "এ থেকে প্রমাণ হল মতুয়ারা আমাদের সঙ্গেই আছেন। গোটা রাজ্যে ভোটে এর প্রভাব পড়বে।"

গোবরডাঙার সভায় তৃণমূল নেত্রীও এ দিন বলেন, "উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে মতুয়ারা আন্দোলন করছেন। নির্বাচন এলেই বলা হয় ওঁদের (উদ্বাস্তু) তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু উদ্বাস্তু ভাইবোনেরা নিশ্চিন্তে থাকুন। মনে রাখবেন, উদ্বাস্তুদের জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করেছি আমি। তাদের গায়ে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। আমি যেমন তফসিলি, সংখ্যালঘুদের ভালবাসি তেমনই উদ্বাস্তুদের নয়নের মণি করে রেখে দিই আমরা। আগামী দিনেও উদ্বাস্তু উন্নয়ন আমরাই করব।" বিজেপিকে ফের কটাক্ষ করে মমতা বলেন, "পদ্মবেশী ছদ্মবেশী সব।"

বনগাঁর গোপালনগরে হরিপদ ইন্সটিটিউশনের মাঠেও এ দিন বাগদার তৃণমূল প্রার্থী উপেন বিশ্বাস, বনগাঁ (উত্তর) প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস এবং বনগাঁ (দক্ষিণ)-এর সুরজিৎ বিশ্বাসের সমর্থনে সভা করেছেন মমতা।


'বদল' তো হবেই! কিন্তু তার পর 'বদলে-যাওয়া' রাজ্য চালাতে তাঁকে সাহায্য করতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেই। কারণ রাজ্য ইতিমধ্যেই 'দেউলিয়া'— খানিকটা আব্দারের ভঙ্গিতেই তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ক্ষমতায় এলে তাদের প্রথম কাজ হবে, রাজ্যের সমস্ত প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সেই কাজে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে সব রকম সাহায্য করবে— জবাবি বক্তৃতায় মমতাকে 'বোন' সম্বোধন করে বললেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রীর 'বস্‌' মনমোহন সিংহ।

এই দু'টি মুহূর্ত জুড়েই তৈরি হল রাজ্যে বিরোধী জোটের সবচেয়ে 'তাৎপর্যপূর্ণ' বার্তা। একই মঞ্চ থেকে। এই ভোটে এই প্রথম!

ভোটের প্রচারে এসে জোটকে জেতাতে হবে, একসঙ্গে লড়তে হবে গোছের বার্তা দেওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু সে সব পেরিয়ে একেবারে নতুন সরকার গঠনের পর কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক 'সহযোগিতা'র আবেদন এবং আশ্বাসের এমন বাতাবরণ সাম্প্রতিক অতীতে দেখেনি এ রাজ্য।

প্রথম দফার প্রচার তো অনেক দূরের কথা, ভোটও শেষ। দ্বিতীয় দফার ভোট ছিল শনিবার। তার প্রচারও শেষ ৪৮ ঘণ্টা আগে। তৃতীয় দফার ভোট আগামী বুধবার। তার প্রচার আপাতত তুঙ্গে। কিন্তু এ দিনের আগে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের 'হেভিওয়েট' নেতাদের একই মঞ্চে দেখা যায়নি। সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী এসে কংগ্রেসের প্রার্থীদের হয়ে প্রচার করে চলে গিয়েছেন। মমতা তাঁর মতো করে নিজের দলের প্রার্থীদের প্রচারে ব্যস্ত থেকেছেন। সনিয়ার সঙ্গে উত্তরবঙ্গে কোনও একটি সভা বা বীরভূমের নলহাটিতে যৌথ প্রচারের সম্ভাবনা থাকলেও তা হয়ে ওঠেনি। সে দিক দিয়ে মমতার সঙ্গে একই মঞ্চে খোদ প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব এই 'জোট-বাজারে' ঘটনা বৈকি! তা-ও আবার এমন একটি এলাকায়, যার অন্তত দুশো মাইলের মধ্যে কোনও কংগ্রেস প্রার্থীর অস্তিত্বই নেই! সাধে কি সভার সভাপতি (তথা সঞ্চালক) দমদমের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সৌগত রায় বললেন, 'ঐতিহাসিক সভা'!

মঞ্চে মনমোহন-মমতার সঙ্গেই ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁঁইয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ। এই 'লাইন-আপ' দেখেই যাঁরা 'আমোদিত', তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যাক, বিরোধী জোট নিয়ে আলোচনা শুরুর সময়েও ওই তিন নেতা মমতার সঙ্গেই ছিলেন। এ দিনের সভার এক এবং একমাত্র 'ফ্যাক্টর' মনমোহন। যতটা না বক্তৃতায় (যেখানে তিনি বলেছেন, "বাংলার রাজধানীর ভবিষ্যতের জন্য শুধু কংগ্রেস-তৃণমূল জোটই করণীয় কাজগুলো করতে পারবে"), তার চেয়ে অনেক বেশি স্রেফ তাঁর উপস্থিতিতে।

ঈষৎ সন্দিগ্ধর া অবশ্য এ দিনের সভার পরেও জানাচ্ছেন, গত লোকসভা ভোটের সময় সনিয়া-মমতা রাজ্যে মাত্র একটিই যৌথ সভা করেছিলেন— মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। জঙ্গিপুরের প্রার্থী প্রণববাবুর সমর্থনে। অর্থাৎ, কংগ্রেসের প্রার্থীর সমর্থনে সনিয়ার সভায় যোগ দিয়েছিলেন মমতা।

কিন্তু তৃণমূলের প্রার্থীর সমর্থনে মমতার কোনও সভায় আসেননি সনিয়া। হাওড়ার ডুমুরজলা ময়দানে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে মমতার সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন এই মনমোহনই। এ বারও কি সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি দেখছে পশ্চিমবঙ্গ? আশাবাদীরা বলতে চান, প্রচারের এখনও বাকি আছে। সনিয়া-মমতা যৌথ প্রচার হতেই পারে। যার পাল্টা বলা হচ্ছে, এর পর তো প্রায় সব 'ইতিবাচক' আসনে মমতারই প্রার্থী। কংগ্রেসকে যে সমস্ত আসন ছেড়েছেন মমতা, সেখানে প্রচারে এসে সনিয়া কি তাঁর 'ব্র্যাণ্ড-ভ্যালু' পড়তে দিতে চাইবেন?

তবে এ দিনের যৌথসভার উদ্দেশ্য 'সফল'। তাঁর বক্তৃতায় মনমোহন সে সবই উল্লেখ করেছেন, যা মমতাও বলে থাকেন। যেমন, "বাংলায় প্রশাসনের গতি স্তব্ধ! নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এই সরকারের কোনও যোগাযোগ নেই।" অথবা, "বাংলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। রোজ রাজনৈতিক সন্ত্রাস হচ্ছে।" কিংবা, "স্বাধীনতার পর মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বাংলার শিল্পায়নের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। সেই বাংলা এখন শিল্পায়নে কোথায় দাঁড়িয়ে? এ রাজ্যের যুবক-যুবতীদের চাকরির জন্য বাইরে যেতে হয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।" যত বার তিনি মমতার নাম উচ্চারণ করেছেন, গর্জন করেছে জনতা। হাততালির ঝড় উঠেছে, যখন বলেছেন, "এখন পরিবর্তনের সময় এসে গিয়েছে। মমতাই হবেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।"

কিন্তু পাশাপাশিই পেশায় শিক্ষক মনমোহন বলেছেন, নতুন সরকার প্রেসিডেন্সির হৃত গরিমা পুনরুদ্ধার করবে। স্কুল-কলেজে শিক্ষার মানোন্নয়ন করবে। বলেছেন, "এটা খুব আফশোসের যে, অমর্ত্য সেনের মতো নোবেলজয়ীর রাজ্যে শিক্ষার হাল এত শোচনীয়! ২০০১ সালে বাংল া সাক্ষ রতায় ছিল দেশের মধ্যে ১৮ নম্বরে। ১০ বছর পরের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, নাগাল্যাণ্ড-মণিপুরও এ রাজ্যের চেয়ে শিক্ষায় এগিয়ে!"

একান্ত আলাপ। দমদমে প্রণব-মমতা।

আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, "গোটা দেশের উন্নয়নের সুফল বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী পায়নি। অসম-গুজরাতের মুসলিমরাও এর চেয়ে অনেক ভাল আছেন!" সাচার কমিটির রিপোর্ট ছাড়াও কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার মুসলিমদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

এরই পাশাপাশি বাংলায় বিনিয়োগের আগমন বন্ধ হয়ে-যাওয়া, স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে-পড়া, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করার অপারগতা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মমতার কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জোটের সুরে।

দমদম সেন্ট্রাল জেলের মাঠে যে ভিড় হয়েছিল, তা অবশ্যই সংগঠিত। এবং মমতাকে খুশি করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ ভিড় মমতা তাঁর একার সভায় একাই জুটিয়ে থাকেন। যেমন এ দিনও দমদমে আসার আগেই জুটিয়ে এসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার পরপর তিনটি সভায়। কিন্তু দমদমের সভার তাৎপর্য অন্য জায়গায়। এক, যৌথ উপস্থিতিতে জোটের বার্তা আরও জোরাল ভাবে দেওয়া। দুই, সভাটা দমদমে করা (সভার জায়গা মমতা নিজেই বেছেছিলেন। প্রথমে তাঁর পছন্দ ছিল ইন্দিরা ময়দান। এসপিজি-র আপত্তিতে তা সরিয়ে নিয়ে আসতে হয় জেল-গ্রাউণ্ডে)। যেখানে তাঁর দলের প্রার্থী নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসুর বিরুদ্ধে লড়ছেন সিপিএমের সম্ভবত সবচেয়ে 'হেভিওয়েট' প্রার্থী গৌতম দেব। দমদমে যে গৌতমবাবুকে প্রার্থী করছে সিপিএম, তা জেনেই মমতা ব্রাত্যকে একটা 'সারপ্রাইজ' দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এত দিনে সেটা হল!

ব্রাত্যর সঙ্গেই সভায় ছিলেন উত্তর দমদমে তৃণমূল প্রার্থী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, কামারহাটির মদন মিত্র, বরানগরের তাপস রায়, বিধাননগরের সুজিত বসু, রাজারহাট-নিউটাউনের পূর্ণেন্দু বসুরা। এই সব সভায় যা হয়, প্রত্যেক প্রার্থীর সঙ্গে মমতা আলাপ করিয়ে দেন মনমোহনের। এ সব সাক্ষাতে মৃদু হাস্য-বিনিময় ছাড়া আর বিশেষ কিছু হয় না। এ দিনও হয়নি। মঞ্চ থেকে আপ্লুত মানসবাবু বলেছেন, "এটা পরিবর্তনের যুগ সন্ধিক্ষণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে বাংলায় নতুন ইতিহাস তৈরি হবে।" প্রথম বাক্যটা ভাঙা বাংলায় বলে দ্রুত হিন্দিতে চলে-যাওয়া শাকিল বলেছেন, "প্রধানমন্ত্রী এমন একটা সময়ে এ রাজ্যে এসেছেন, যখন রাজ্যের জনতা বাম সরকারকে ছুড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। যখন কংগ্রেস-তৃণমূলের সরকার হবে এবং মমতা তার মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তখন প্রধানমন্ত্রী সেই সরকারকে পরামর্শ দেবেন।"

স্বভাবতই, রাজ্যে জোটের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করেছেন প্রণববাবু। এবং সরাসরি বলেছেন, তাঁরা (কংগ্রেস) ১৯৭৭ থেকে চেষ্টা করেও বামফ্রন্টকে হটাতে পারেননি। বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার কথায়, "ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। সেই ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর নৃশংস হত্যার ঘটনার আবেগে লোকসভায় ১৬টা আসন পাওয়া ছাড়া। তাই ২০০৯-এ আমি আর মমতা সনিয়া-মনমোহনের পরামর্শ নিয়ে জোট গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কোনও দিকে না-তাকিয়ে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পরামর্শে। অভূতপূর্ব ফল হয়েছিল।" এক নিঃশ্বাসে বিধানসভা ভোটে জোটেরও অন্যতম কারিগর প্রণববাবু বলেছেন, "বিধানসভার জোটের প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল লোকসভার ভোটেই। কারণ, মানুষ বিশ্বাস করতে পেয়েছিলেন যে, কংগ্রেস-তৃণমূল একত্র হলে সিপিএম-কে হটানো যায়। তাঁদের মনে বিশ্বাস এসেছিল যে, জোট পারবে। প্রধানমন্ত্রীও এখানে সেই বার্তাই দিতে এসেছেন।"

আর মমতা?

মনমোহনের সামনেই ঘোষণা করলেন, "আমরা ক্ষমতায় এলে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করব বাংলার বুকে।" মনমোহন চলে যাওয়ার পর তৃপ্ত জোটনেত্রী রওনা দিলেন দমদম পার্কে তাঁর পরের সভায়। যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে বিপুল জনতা।

শনিবার অশোক মজুমদারের তোলা ছবি।

first page

rajya

next story


ভোটযন্ত্রে সাদা কাগজ, নালিশের পর
সরানো হল প্রিসাইডিং অফিসারকে

নিজস্ব প্রতিবেদন

ইচই শুরু করে দিয়েছিলেন বেশ কিছু ভোটার। ভোটযন্ত্রে একটি প্রতীকের পাশে সাদা কাগজ সাঁটা রয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী অভিযোগ তুললেন, সিপিএমকে ভোট দেওয়ার জন্যই ওই সাদা কাগজের ইঙ্গিত। তাহেরপুরে এই ঘটনায় জনতা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয় বলেও অভিযোগ। নির্বাচন কমিশন অবশ্য কোনও ঝুঁকি নেয়নি। ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের রথতলা কলোনি হাইস্কুলের একটি বুথে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে সেখানকার প্রিসাইডিং অফিসারকেও সরিয়ে দেওয়া হয় সকালেই। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির কাতলামারির একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকেও সরানো হয়।

শনিবার দ্বিতীয় দফার ভোটের দিনে বেলডাঙার দেবকুণ্ডু (সেক্টর ১৭) এলাকায় আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন কর্মরত এক পুলিশ কর্মী। তিনি নৈহাটি থানায় এএসআই পদে ছিলেন। দীপক বরুয়া (৫০) নামে ওই পুলিশ কর্মীকে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান। ভরতপুর বিধানসভা কেন্দ্রের কড়াইসল প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সনৎ মণ্ডল এবং ওই বিধানসভা কেন্দ্রের ভরতপুর মাদ্রাসা বুথের প্রিসাইডিং অফিসার অমিয়কুমার দে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই দু'টি বুথে নতুন করে প্রিসাইডিং অফিসার দিয়ে তাঁদের ভরতপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। পরে একটু সুস্থ বোধ করলে ফের তাঁরা ভোটগ্রহণের দায়িত্ব নেন। নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রে নবদ্বীপ ধাম বুথে প্রিসাইডিং অফিসার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতার জন্য বীরভূমের দুবরাজপুর, সিউড়ি, রামপুরহাট, হাসন বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথের মোট সাত ভোট কর্মীকে বদল করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জন প্রিসাইডিং অফিসার আছেন। ভোট যন্ত্রের সিল খুলতে না পারায় খয়রাশোল ব্লকের ছোরা গ্রামে রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হয়েছে। এ দিন মোট ৯১টি ভোটযন্ত্র খারাপ হয়ে গেলে তা বদলে দিতে হয়েছে। ডোমকলে ১৪৮ নম্বর বুথে দু'দলের এজেন্টের মধ্যে বচসা হয়। সালারে ১১৯ নম্বর বুথে কংগ্রেসের এক নির্বাচনী এজেন্টকে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদে ১১টা, নদিয়ায় ৫টা মোট ১৬টা বুথে ভোট বয়কট হয়েছে। তবে বীরভূমে গোটা তিনেক বুথে ভোট বয়কট হবে বলে আগাম খবর ছিল, সেক্টর অফিসার ও রিটার্নিং অফিসাররা গিয়ে বুঝিয়ে ভোট চালু করেন।

গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের পর নতুন ভোটাররা

কল্যাণীতে বিতান ভট্টাচার্যের, দুবরাজপুরে দয়াল সেনগুপ্তের তোলা ছবি।

সব ক্ষেত্রেই তৎপর ছিল নির্বাচন কমিশন। ফলে, নির্বিঘ্নে নির্বাচনপর্ব মিটেছে। কিন্তু ভোট পরবর্তী কিছু গোলমাল এড়ানো যায়নি।

নদিয়ার হাঁসখালি থানার কৈখালি পুরাতন পাড়ায় ভাঙচুর করা হল বিদায়ী মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস ও এই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী অর্চনা বিশ্বাসের নির্বাচনী এজেন্ট দীপিকা বিশ্বাসের গাড়ি। তবে তাঁরা কেউই আহত হননি। বিনয়কৃষ্ণবাবু বলেন, "বাম বিরোধীদের সন্ত্রাসের ফলে আমরা ওই এলাকায় একটি বুথে পোলিং এজেন্ট দিতে পারিনি। ভোটপ্রক্রিয়া মিটে যাওয়ার পরে দীপিকাদেবী ওই বুথে গেলে তাঁকে আটকে রাখেন বেশ কয়েকজন বাম বিরোধী কর্মী-সমর্থক। আমরা সে কথা শুনে সেখানে গেলে আমাদেরও তাঁরা হেনস্থা করেন। আমাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।" পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি শশাঙ্ক বিশ্বাসের বক্তব্য, "বামেরা দাবি করেছেন, ওই বুথে নির্বাচন অবৈধ। কিন্তু সকাল থেকে তাঁরা কোনও নির্বাচনী এজেন্টই দিতে পারেননি। তাই এলাকার লোকজন তাঁদের অভিযোগ শুনে নিজেরাই ক্ষুব্ধ হয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেছেন।" এই দিনই ওই জেলারই মাজদিয়াতে কৃষ্ণগঞ্জ থানার ভাজনঘাট হরেকৃষ্ণ পল্লিতে ভোটের পর বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তৃণমূল সমর্থকদের সঙ্গে সিপিএমের কর্মীদের গণ্ডগোল শুরু হয়। সেই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে পুলিশও আক্রমণের মুখে পড়ে। অভিযোগ, পুলিশের উপরে চড়াও হয় দুই রাজনৈতিক দলেরই সদস্যেরাই। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আহত হয়েছেন এক জন পুলিশ অফিসারও। তারপরে আধা সামরিক বাহিনী লাঠি চালায় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

ভোট চলাকালীন ছোটখাট গণ্ডগোল হয়েছে অন্যত্রও। বীরভূমের নানুরের নবস্থা ও সেহালা গ্রামে ভোট কেন্দ্রে তৃণমূলের এজেন্টকে সিপিএম ঢুকতে দেয়নি বলে অভিযোগ। বালিগুণী, তিলখুণ্ডি, পালিতা-সহ ১০-১২টি গ্রামে তাদের এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে সিপিএমেরও অভিযোগ। ভোট দানে বাধা সৃষ্টি করার জন্য দুবরাজপুর ও ইলামবাজার থেকে দু'জনকে মদ্যপ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের শাহিদপুরে মহাতাপ শেখ তাঁর বাড়ির তিন সদস্যকে নিয়ে ভোট দিতে এলে সিপিএম কর্মীরা তাঁকে ফিরিয়ে দেন 'তোর ভোট পড়ে গিয়েছে' বলে। তিনি ফিরে গিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী আখরুজ্জামানকে ঘটনাটি বললে তিনি নিজের গাড়িতে মহাতাপকে নিয়ে আসেন। শুরু হয় বাগবিতণ্ডা। ভাঙচুর হয় কংগ্রেস প্রার্থীর গাড়ি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে সিপিএম সমর্থকেরা পালিয়ে যান।

দুবরাজপুরে দয়াল সেনগুপ্তের তোলা ছবি।

শুক্রবার রাতে পলাশিপাড়া বিধানসভার প্রার্থী সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এসএম সাদির ইলেকশন এজেন্ট সমীরণ কর্মকার এবং তার গাড়ির চালক উজ্জ্বল শেখকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতদের কাছ থেকে ২৫টি পোস্টাল ব্যালট পেপার পাওয়া যায়। ওই ব্যালট তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন, তার সদুত্তর মেলেনি বলে জানিয়েছে প্রশাসন। ওই গাড়ি ব্যবহারের কোনও অনুমতি জেলাপ্রশাসনের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ। পরে ওই গাড়িটিকেও আটক করে পুলিশ। তেহট্ট মহকুমা আদালতে হাজির করে।

জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, "নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য ওই গাড়িটির কোনও বৈধ অনুমোদন মেলেনি। তা ছাড়া ওই প্রার্থীর এজেন্টের কাছ থেক বেশ কিছু পোস্টাল ব্যালটও পাওয়া গিয়েছে। তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।" সিপিএম প্রার্থী এস এম সাদি অবশ্য জানান, ঘটনাটি নিছকই 'রটনা'।


এক নজরে

4_6e মন্ত্রী বিনয় বিশ্বাসের গাড়ি ভাঙচুর হাঁসখালিতে।
4_6e তিন প্রিসাইডিং অফিসারকে সরানো হল রানাঘাট দক্ষিণ ও জলঙ্গিতে।
4_6e বেলডাঙায় অসুস্থতায় মৃত্যু পুলিশকর্মীর।
4_6e বীরভূমে এক প্রিসাইডিং অফিসার-সহ সাত কর্মী অসুস্থতার কারণে বদলি।
4_6e মোট ৯১টি ইভিএম বিকল।
4_6e ইভিএমের সিল খোলায় সমস্যা। রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট খয়রাশোলে।
4_6e গ্রেফতার ৫ জন।
4_6e জঙ্গিপুরে ভোট বয়কটকে ঘিরে মারপিটে সিপিএম নেতা।


গৌতমকে মুখে লাগাম দিতে বলল আলিমুদ্দিন

জয়ন্ত ঘোষাল • কলকাতা

বেশ কিছু দিন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করছিলেন রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী। তুলছিলেন বেশ কিছু ব্যক্তিগত, এমনকী, দুর্নীতির অভিযোগও। প্রথম দিকে সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছিলেন, গৌতমবাবুর আক্রমণ মমতা তথা তৃণমূলকে যথেষ্ট 'রক্ষণাত্মক' করে দিয়েছে। পাশাপাশিই, এর মাধ্যমে দলের নিচু তলার 'হতাশ' কর্মীরাও 'উজ্জীবিত' হচ্ছেন। কিন্তু এখন সিপিএম নেতৃত্বের একটি বড় অংশ মনে করছেন, গৌতমবাবুর 'অতি-আক্রমণ' ক্রমশ দলকে আখেরে বিপদেই ফেলছে। গত কাল স্টার আনন্দের সাক্ষাৎকারেও গৌতমবাবু বহু প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি বলে দল মনে করছে। আজ রাজ্য নেতারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে গৌতমবাবুকে জানিয়েছেন, এখনও বেশ কয়েক পর্বের ভোট বাকি। আপাতত 'ধীরে চলো' নীতি নিন তিনি।

বস্তুত, যে ভাবে সাক্ষাৎকারে তাঁকে সাদা পাতা দেখিয়ে খানিকটা 'হাস্যস্পদ' করা হয়েছে, তার জন্য গৌতমবাবুর নিজস্ব প্রতিক্রিয়াও দায়ী বলে মনে করছেন নেতৃত্বের একাংশ। তিনি যেমন জনৈক তৃণমূল নেতার চিঠি বলে সর্বসমক্ষে কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ে চলেছেন এবং লেখকের নাম প্রকাশ করছেন না, তেমন ভাবেই সাক্ষাৎকারেও তাঁকে একটি 'অস্তিত্বহীন' চিঠি পড়ে শোনানো হয়। যা শুনে প্রবল উত্তেজিত হয়ে মামলার হুমকি দিয়ে বসেন গৌতমবাবু। তখন তাঁকে দেখানো হয়,

ওই রকম কোনও চিঠিই নেই! মৃদু হেসে বিষয়টি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও তত ক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে বলেই অভিমত আলিমুদ্দিনের।

সমস্যা আরও রয়েছে।

রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য আজ বলেন, প্রথমত, গৌতমবাবুর 'ব্যক্তিগত' আক্রমণের ফলে তৃণমূলও নানা স্তরে পাল্টা 'ব্যক্তিগত' আক্রমণে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। গত কালই বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা সুচেতনার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী-তনয়া যে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে জড়িত, তার আয়ের উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। সিপিএম নেতৃত্ব যখন বলছেন, ওই অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই, তখন পাল্টা তৃণমূল শিবির থেকে বলা হচ্ছে, গৌতমবাবুর অভিযোগেরও তো কোনও তথ্যপ্রমাণ পেশ করা হয়নি!

প্রকাশ কারাট থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু সকলেই মনে করছেন, এই 'তুই-তোকারির' চাপানউতোরে রাজনৈতিক প্রচারের যে 'গাম্ভীর্য' নষ্ট হচ্ছে, তাতে সিপিএমের দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভ হচ্ছে না। গত কাল বিমানবাবু প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ওই অশালীন ভাষা ব্যবহারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সেটা গৌতমবাবু করলেও তিনি তা সমর্থন করেন না। শুক্রবার দলের প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুর আরামবাগে করা 'অশালীন' মন্তব্য আলিমুদ্দিনে এই বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে। এর মধ্যে আবার অন্য প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠও এক সাক্ষাৎকারে বলে বসেছেন, নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়ে ঠিক করেছিল! এই অবস্থায় সিপিএম নেতৃত্ব এখন তাই রাজ্য নেতাদের 'বাক-সংযমী' হওয়ার উপদেশ দিতে চান।

পাশাপাশিই এখন সিপিএম-তৃণমূল লড়াইয়ের চেয়েও শাসক দলের অন্দরে রাজনৈতিক ভাবে আরও বেশি 'তাৎপর্যপূর্ণ' হয়ে উঠেছে বুদ্ধ-গৌতম লড়াই। ভোটের ফলাফল এই লড়াইয়ের পরিণতি নির্ণয় করবে। কিন্তু আপাতত আলিমুদ্দিনের এই সুপ্রাচীন দ্বৈরথ অব্যাহত। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধবাবুর সমর্থনে এগিয়ে না-এসে গৌতমবাবু সাফ বলে দেন, "উনিই এ সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।" প্রশ্ন ছিল, কেমিক্যাল হাবে ডাও কেমিক্যালসকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে উইকিলিকসে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে তথ্য ফাঁস। গৌতমবাবুর ওই জবাবের ফলে দলকে মুখ্যমন্ত্রীর পুরনো বক্তব্য আবার আলাদা ভাবে জানাতে হয়। একই ঘটনা ঘটে কারাটকে নিয়েও। তাঁর সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেও গৌতমবাবু জুৎসই জবাব দিতে পারেননি। তাতে দল আরও অস্বস্তিতে। চ্যানেলে শরীরী ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য নেতৃত্বের অনেকে মনে করছেন, গৌতমবাবুর মাপের এক জন নেতা (যিনি কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য) যখন চ্যানেলে যাচ্ছেন, তখন দলের মুখপাত্র হিসেবেই যাচ্ছেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী থেকে দলের সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে তোলা প্রশ্নের জবাব দেওয়া তাঁর 'দায়িত্ব' ছিল।

গৌতমবাবু অবশ্য মনে করেন, বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমের কাছে যাওয়া এবং তাদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। বরং দলের নেতৃত্ব কিছু চ্যানেলে যাওয়ার উপর যে ভাবে 'নিষেধাজ্ঞা' জারি করেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে। আলিমুদ্দিনের মিডিয়া কমিটির ফরমান অগ্রাহ্য করে গৌতমবাবু চ্যানেলে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যে সাহস অনেক সিপিএম নেতা দেখাতে পারেননি। কিন্তু গৌতমবাবুর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, কারাটও ক্ষুব্ধ। বরং গৌতম-প্রশ্নে কারাট-বুদ্ধ অনেক কাছাকাছি এসেছেন। সীতারাম ইয়েচুরি-বৃন্দা কারাটও এখন শহরে জনসভা করছেন। কিন্তু তাঁরাও কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটছেন না।

গৌতমবাবু তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে 'কুপন কেলেঙ্কারি'র অভিযোগ তুলেছেন, তা-ও ক্রমশ রাখাল বালকের পালে বাঘ পড়ার কাহিনির মতো হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সিপিএমের রাজ্য নেতারা। দলের কাছে গৌতমবাবু ওই ব্যাপারে কোনও তথ্যপ্রমাণ পেশ করেননি। বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রয়োজনে সব তথ্য পেশ করবেন। সিপিএম সূত্রের খবর, বিমানবাবু গৌতমবাবুকে বলেছেন, তথ্যপ্রমাণ থাকলে কলকাতায় ভোট হওয়ার আগেই সাংবাদিক বৈঠক করে সমস্ত ফাঁস করুন তিনি। গৌতমবাবু অবশ্য চাপের মুখে একে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ পথ। তাই আলিমুদ্দিন বললেও গৌতমবাবু রণে ভঙ্গ দেবেন, এমন ইঙ্গিত মেলেনি। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। বিমানবাবু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন গৌতমবাবুর মতো নেতার মুখে লাগাম পরাতে।

ব্যাপার দেখেশুনে এক বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠের মন্তব্য, ''গৌতম গান গাইতে জানে। কিন্তু থামতে জানে না। প্রথমে ওর বক্তব্য নিয়ে দলের অনুগামীদের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই। ও-ও তারকা প্রচারক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন আর ওটা হচ্ছে না। বরং বারবার একই কথা একই ঢংয়ে বলতে বলতে গোটা বিষয়টিকেই ও একঘেয়েমির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।" অসাধারণ উদাহরণ দিয়ে তাঁর বক্তব্য, "বলিউড ফিল্মে যেমন একটা সিনেমায় আইটেম নাম্বার হিট করলে পরপর সব ছবিতে আইটেম নাম্বার জুড়ে দেওয়া হয় আর অভিনয়টা মার খায়, গৌতমের অবস্থাও তেমনই। ও এখন স্রেফ আইটেম নাম্বার হয়ে গিয়েছে!"

কদর্যতার সীমা ছাড়ালেন অনিল, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদন

ভোটের ময়দানে কুৎসা ব্যবহারের সাম্প্রতিক 'প্রতিযোগিতা'য় সব নজির ছাড়িয়ে গেলেন আরামবাগের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অনিল বসু! এর আগেও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় আরামবাগে এক সভায় যে ভাষায় এবং ভঙ্গিতে মমতাকে আক্রমণ করেছেন সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অনিলবাবু, সাম্প্রতিক কালে তা যেমন নজিরবিহীন, তেমনই ছাড়িয়েছে শালীনতার চূড়ান্ত মাত্রাও। কোনও শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না-করে প্রকাশ্য জনসভায় ভোটের খরচ নিয়ে মমতার সমালোচনা করতে গিয়ে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের উপমা ব্যবহার করেছেন অনিলবাবু!

ভোট চলাকালীন অনিলবাবুর এমন 'অশালীন' মন্তব্যে এক দিকে যেমন চরম বিপাকে পড়েছে সিপিএম, তেমনই প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে সব মহলে। বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হতেই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কড়া বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, কমিউনিস্ট পার্টির এক জন নেতার মুখে এমন ভাষা ভাবা যায় না! তাঁর আচরণ 'ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ'। অনিলবাবুকে অবিলম্বে সতর্ক করার জন্যও দলীয় নেতৃত্বকে বলেন বুদ্ধবাবু। সেই মতো রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু প্রাক্তন সাংসদকে ফোন করে সতর্ক করেন এবং সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তাঁকে 'ভুল' স্বীকার করতে বলেন।


অনিল বসু

শনিবার রাত পর্যন্ত অনিলবাবু অবশ্য 'ভুল' স্বীকার করেননি। বরং তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, "আমি কী আক্রমণ করেছি, কিছুই বুঝতে পারছি না!" পক্ষান্তরে, মমতা অনিলবাবুর ওই বক্তব্যের সিডি পাঠাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীর কাছে।

মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিএম ক্ষতি সামাল দিতে আসরে নামলেও তত ক্ষণে

অবশ্য যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, "টেলিভিশনের পর্দায় বামফ্রন্টের বড় এক নেতা শ্রী অনিল বসুর ভাষণ শুনলাম এবং দেখলাম। তাঁর ভাষায় আর শারীরিক ভঙ্গিতে যে অশালীনতা আর হিংস্রতার প্রকাশ দেখা গেল, তার নীচতায় এবং ভয়ঙ্করতায় আমি স্তম্ভিত! এক হিসেবে অবশ্য ভালই হল যে, দেশের মানুষ বুঝতে পারলেন, বহু-ঘোষিত শুদ্ধকরণের পরে এই হচ্ছে আজ বামফ্রন্টের প্রকৃত মুখচ্ছবি!" শঙ্খবাবু কখনওই 'মমতাপন্থী' বিশিষ্ট জন হিসেবে পরিচিত নন। বিদ্বৎমহলে তাঁর অনন্য পরিচিতি রয়েছে। সেই শঙ্খবাবুর এমন প্রতিক্রিয়ায় ভোট-প্রক্রিয়ার মধ্যে বহু গুণ বিড়ম্বনা বেড়েছে সিপিএমের।

প্রত্যাশিত ভাবেই অনিলবাবুর মন্তব্য ঘিরে তেতে উঠেছে তৃণমূল শিবির। অনিলবাবুর নাম না-করে এ দিন উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায় এক প্রচারসভায় মমতা বলেন, "সিপিএম হেরে যাবে বলে কী ভাষা বলছে, কী ভাবে কুৎসা রটাচ্ছে, তা আপনারাই দেখুন।" মুখ্যমন্ত্রী যে অনিলবাবুকে সতর্ক করার কথা বলেছেন, তার প্রেক্ষিতে তৃণমূল নেত্রীর প্রতিক্রিয়া, "উনি (মুখ্যমন্ত্রী) সব জানেন। তার পরে আবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন! ওই নেতা (অনিলবাবু) তো আগেও এমন সব মন্তব্য করেছেন। কোনও বারই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বা সিপিএম নেতৃত্বের এই ধরনের বিবৃতি সবই অন্তঃসারশূন্য!"

বস্তুত, তৃণমূল নেত্রীকে প্রকাশ্যেই একাধিক বার তীব্র কটূক্তি করেছেন অনিলবাবু। যেমন, সিঙ্গুর থেকে মমতাকে 'চুলের মুঠি ধরে বার করে' দেওয়ার কথা তিনি এক বার বলেছিলেন। কিন্তু শুক্রবারের মন্তব্য কদর্যতায় অতীতের সব নজিরকে ছাপিয়ে গিয়েছে। আরামবাগের দলীয় প্রার্থী অসিত মালিকের সমর্থনে সভায় মমতাকে কখনও 'তুই', কখনও 'তুমি' সম্বোধন করেছেন অনিলবাবু। তাঁর চেহারা নিয়ে বক্রোক্তি করেছেন। বলেছেন, "মমতা উটমুখী! খালি উপরের দিকে তাকায়! আশপাশে কী হচ্ছে, দেখতে পায় না। আমি বলি, ওরে উটমুখী, আরামবাগে আয়! দেখে যা পরিবর্তন কাকে বলে! উন্নয়ন কাকে বলে!" এর পরেই তৃণমূলের টাকার উৎস নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে যৌনকর্মীদের উপমা টানেন তিনি!

অনিলবাবুর এমন 'রুচিহীন আক্রমণে'র পরে তাঁকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে তৃণমূল। হুগলি জেলা তৃণমূলের পক্ষ থেকে এ দিনই বিকালে চুঁচুড়ায় অনিলবাবুর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর কিছু আগেই, তোলাফটক এলাকায় বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ। অনিলবাবুর কুশপুতুল পুড়িয়ে সেখানেই বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। চুঁচুড়ার ঘড়ির মোড়েও বিক্ষোভ হয়।

অনিল বসুর বাড়ির কাছে তৃণমূলের বিক্ষোভ।— তাপস ঘোষ

অনিলবাবুর বক্তৃতার সিডি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তর কাছে জমা দেন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সুনীলবাবু বলেন, "পার্থবাবু অনিলবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। অনিলবাবুর বিরুদ্ধে পৃথক ভাবে আরও একটি অভিযোগ জানিয়েছেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। ওই দুই নেতাই অনিলবাবুকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। যে দু'টি অভিযোগ এবং একটি সিডি জমা পড়েছে, তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে।" জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছেও অভিযোগ করেছে তৃণমূল। নির্বাচন কমিশন হুগলির জেলাশাসক শ্রীপ্রিয় রঙ্গরাজনের কাছে অনিলবাবুর মন্তব্যের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। জেলাশাসক ওই সভার ভিডিও ফুটেজ কমিশনে পাঠাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। অনিলবাবুর মন্তব্য তাঁদের দলের 'নৈতিক অধঃপতনেরই পরিচায়ক' বলে সমালোচনা করেছে তৃণমূলের জোটসঙ্গী এসইউসি (সি)।

খোদ অনিলবাবু এ দিন বলেন, "বুদ্ধবাবু কী বলেছেন, আমি শুনিনি। কিন্তু উনি যদি বলে থাকেন, আমার মন্তব্য ক্ষমার অযোগ্য, তা হলে সেটাই শেষ কথা। আমার আর কিছু বলার নেই। আর আমার বাড়িতে যে এ দিন আক্রমণ হল, সেটা কোন নীতিতে পড়ে?" শুক্রবারের মন্তব্যের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, সে ব্যাপারে অনিলবাবু স্পষ্ট উত্তর দেননি। তাঁর কথায়, "বুদ্ধবাবুই শেষ কথা। এর পরে আমার আর কিছু বলার নেই।"

ভোট চলাকালীন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলনেত্রীর নাম করে অনিলবাবুর কুৎসিত বক্তব্যের পরে স্বভাবতই চরম বেকায়দায় পড়েছে সিপিএম। বুদ্ধবাবু তাঁর কড়া বিবৃতিতে বলেছেন, 'আমি শুনেছি অনিল বসু কালকে একটি সভাতে যে কথা বলেছেন, তাতে কোনও ভদ্রতা, কোনও শালীনতার ধার ধারেননি। এটা কমিউনিস্ট পার্টির এক জন নেতার মুখে ভাবা যায় না। আমি তাঁকে আর কী বলি! আমি ইতিমধ্যে পার্টির সহকর্মীদের বলেছি তাঁকে এক্ষুনি সতর্ক করুন। যেন তাঁর মুখ থেকে এই ধরনের ভাষা আর শুনতে না হয়। এ একেবারে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ!" বিমানবাবুও বলেন, "অনিলবাবুর বক্তব্য দল সমর্থন করে না। আমি ফোনে তাঁকে সতর্ক করেছি। তিনি অন্যায় করেছেন। যে ভাবে তিনি বক্তব্য রেখেছেন, সে ভাবেই সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তিনি যাতে ভুল স্বীকার করেন, সে কথা তাঁকে বলা হয়েছে।" রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমও জানান, অনিলবাবুর বক্তব্য দল অনুমোদন করছে না। অতীতে একাধিক বার অশালীন মন্তব্য করেও পার পেয়ে গিয়েছেন অনিলবাবু। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তার স্পষ্ট জবাব অবশ্য সেলিম দেননি।

রাজ্য নেতৃত্ব কড়া অবস্থান নিলেও শুক্রবারের ওই সভায় উপস্থিত আরামবাগের বর্তমান বিধায়ক বিনয় দত্ত অনিলবাবুর মন্তব্যে কোনও 'অশালীনতা' খুঁজে পাননি! রাজ্য রাজনীতিতে এ নিয়ে যতই হইচই হোক, তা 'অযৌক্তিক' এবং 'মিডিয়ার হইচই' বলে মনে করছেন তিনি! বিনয়বাবু বলেন, "অনিলবাবু খুব উপযোগী কথা বলেছেন। প্রচুর হাততালি পড়েছে। কোনটা শ্লীল, কোনটা অশ্লীল বুঝব কী করে? তৃণমূল নেত্রী যখন আমাদের চোর-ডাকাত, কিংবা আমার পাঁঠা লেজে কাটব নাকি মাথায় কাটব, তোদের কী বলেন, সেটা অশ্লীল নয়?" দলে 'সতর্কিত' অনিলবাবু অবশ্য এ দিন খানাকুলের সভায় তৃণমূলের 'সন্ত্রাস' নিয়ে নানা অভিযোগ তুললেও মমতাকে আর কোনও কটূক্তি করেননি!


জোট এলে হারানো গৌরব ফিরে পাবে প্রেসিডেন্সি

নিজস্ব সংবাদদাতা

বামফ্রন্ট সরকারের হাতে প্রেসিডেন্সি তার হারানো সুদিন ফিরে পাবে না বলে জানিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তাঁর আশ্বাস, "রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের সরকার হলে প্রেসিডেন্সির হৃতগৌরব ফেরানোর চেষ্টা হবে।"

জোটপ্রার্থীদের হয়ে এ রাজ্যে প্রচারে এসে শনিবার কাটোয়া ও দমদম দু'জায়গাতেই ব্যতিক্রমী এই প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। চরম উত্তেজক নির্বাচনী চাপানউতোরের মধ্যে যা একটু টাটকা বাতাসের মতো। রাজ্যের প্রধান দলগুলির নেতানেত্রীদের প্রচারে, এমনকী তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারেও প্রেসিডেন্সির উল্লেখ নেই। কিন্তু দিল্লিতে বসেও তিনি যে একদা ঐতিহ্যশালী এই প্রতিষ্ঠানের খবর রাখেন, শনিবারের ঝটিকা সফরে তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রেসিডেন্সি যে তার গৌরব হারিয়েছে, এ নিয়ে রাজ্যের শিক্ষিত সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই একটা হতাশা রয়েছে। তার সব চেয়ে বেশি বহিঃপ্রকাশ ওই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীদের মধ্যে। তাঁদের অনেকেই তাই প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছেন।

রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী অবশ্য প্রেসিডেন্সি নিয়ে মনমোহনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চড়া সুরে। তাঁর মতে, "কেবল প্রেসিডেন্সিই নয়, রাজ্যে শিক্ষার অগ্রগতির প্রধান শর্তই হল কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ক্ষমতায় না আসা।"

প্রেসিডেন্সি যে তার মান ধরে রাখতে পারছে না— দীর্ঘকাল ধরেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তা বলে আসছেন। এবং এর প্রধান কারণ হিসেবে তাঁরা এক বাক্যে দায়ী করেছেন আলিমুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণকে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে উপাচার্য অমিতা চট্টোপাধ্যায়ও অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, ওই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি আগের মতো নেই এবং তার পুনরুদ্ধারও সহজ কাজ নয়। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণই এই ব্যাপারে প্রধান বাধা কি না, সে সম্পর্কে অবশ্য তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।

রাজ্য সিপিএমের প্রাক্তন সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এক সময় রাজ্যের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অনিলবাবুর মৃত্যুর পরেও সেই ধারায় ছেদ পড়েনি। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে আশ্বাস দেন, প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হবে না। কিন্তু দীর্ঘদিনের দাবি-দাওয়ার পরে প্রেসিডেন্সি যখন কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত হল, তখনও দেখা গেল, তার নিয়ম-বিধির মধ্যে দলতন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি।

প্রশ্ন হল, কংগ্রেস-তৃণমূল ক্ষমতায় এলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধ করবে, না তারাও সিপিএমের পথেই হাঁটবে?

প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, আইআইএম (কলকাতা)-র অধ্যাপক অনুপ সিংহের কথায়, "রাজনীতিবিদেরা তোএমন কত কথাই বলেন! প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বলেই ওঁর কথা বিশ্বাস করব, এমনটা নয়। যদি সত্যি সত্যি হয়, তা হলে তো ভাল।" তাঁর মতে, একটা ব্র্যাণ্ড এক বার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার গরিমা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। এ জন্য অনেক সময় লাগে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়া ওই প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ।

অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রেসিডেন্সির আর এক প্রাক্তনী, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরে বিকাশবাবু তার কাউন্সিল সদস্যও বটে। তিনি বলেন, "রাজনীতির উত্তেজক পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী যে আলাদা করে প্রেসিডেন্সির কথা মনে রেখেছেন, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্ম উনি বোঝেন।" বিকাশবাবুর বক্তব্য, "প্রেসিডেন্সির গরিমা ফেরাতে গেলে প্রথমেই ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে যেতে হবে। ওই পরিবেশটাই ছাড়তে হবে। তাপ্পি মেরে হবে না। নতুন করে শুরু করতে হবে।"

দিল্লিতে থেকেও প্রেসিডেন্সির ভাল-মন্দের খবর রাখেন এমন এক বিশিষ্ট প্রাক্তনীর আবার দাওয়াই, "প্রতিষ্ঠানকে ঠিকঠাক ভাবে চালাতে হলে অতিরিক্ত সরকার নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা দরকার।" নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রাক্তনী অবশ্য প্রেসিডেন্সির গৌরব পুরোপুরি লুপ্ত হয়েছে বলে মানেন না। যদিও গৌরবের ক্ষয় যে হয়েছে সে কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেছেন, "আগের গৌরব ফেরাতে হলে শিক্ষক নিয়োগে আরও যত্নবান হতে হবে। ঠিকঠাক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দিতে হবে।"

বাম আমলে সেই স্বাধীনতা ছিল না, এমন অভিযোগ অস্বীকার করে সুদর্শনবাবুর বরং দাবি, কংগ্রেসের জোট ক্ষমতায় এলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক নৈরাজ্য নামিয়ে আনবে। কারণ, কংগ্রেস আমলেই প্রেসিডেন্সি তার গৌরব হারিয়েছে। তিনি বলেন, "প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা করি। তিনি প্রধানমন্ত্রী বলেই নয়, বিশিষ্ট অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ হিসেবেও। তবে তাঁর সারল্যের জন্য ঈর্ষা হয়। যে যা বোঝাচ্ছে, তা-ই উনি বলে দিচ্ছেন।"

যদিও দিল্লিতে সংস্কৃতি মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তার মতে, মোটেই তা নয়। প্রেসিডেন্সি যে ভাল নেই, প্রধানমন্ত্রী তার খবর রাখেন। কেবল ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের ঐতিহ্যশালী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রায় দু'বছর তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রকেরও দায়িত্বে ছিলেন। ওই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তার কথায়, কাদের কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের খবর ঠিক ঠিক পাওয়া যাবে, তার সুলুকসন্ধান প্রধানমন্ত্রী রাখেন। তাই প্রেসিডেন্সি নিয়ে তাঁর আশ্বাস মোটেই কাকতালীয় নয়।

ঘটনা হল, শুধু প্রেসিডেন্সি নয়, বিশ্বভারতী থেকে শুরু করে এশিয়াটিক সোসাইটি, ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ন্যশনাল লাইব্রেরির মতো এ রাজ্যে থাকা জাতীয় গর্বের প্রতিষ্ঠানগুলির কথাও শনিবার তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ কোনও আগ্রহ দেখায়নি বলে অভিযোগ করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর সরকার যে বিপুল অর্থ সাহায্য দিয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

ভোটের দিনেও স্বেচ্ছাবন্দি 'আহত-অপমানিত' সিংহ

সুব্রত বস ু • চাকদহ

সিংহবাগানে কার্যত স্বেচ্ছাবন্দি 'আহত-অপমানিত' সিংহ। শনিবার রাজ্যে দ্বিতীয় দফা ভোটের দিনও তাঁর নড়চড় হল না।

এক সময় তাঁর দাপটে রানাঘাট, চাকদহ এলাকায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই কংগ্রেসের নদিয়া জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহের। এলাকায় থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। ফলে এখন ভাঙন ঠেকিয়ে দলকে বাঁচাতে মরিয়া শঙ্কর। সেই উদ্দেশ্যেই এ বার বিধানসভা ভোটে নদিয়ায় চার-চারজন গোঁজ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তাঁদের 'নীতিগত ভাবে' সমর্থন জুগিয়েছেন। তবে তাঁদের হয়ে প্রকাশ্যে প্রচারে নামেননি। ভোটের দিনও শঙ্করকে চার গোঁজ প্রার্থীকে নিয়ে তাঁকে তেমন চিন্তিত হতে দেখা গেল না। সারা সকাল বাড়িতে কাটিয়ে, ভোটকেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভোট দিয়ে দুপুরবেলা নদিয়া ছেড়ে তিনি প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে।

নিজের জেলায় ভোট। অথচ কী আশ্চর্য নিরুত্তাপ নদিয়ার এই জেহাদি কংগ্রেস নেতা! সকালে ভোটকেন্দ্রের সামনে যখন লম্বা লাইন, তখন নিজের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন শঙ্কর। বেলা করে ঘুম থেকে ওঠাই তাঁর অভ্যাস। কিন্তু এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনেও সেই রুটিনে ছেদ পড়ল না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা গিয়ে হাঁকডাক করে তাঁর ঘুম ভাঙাল।

নদিয়ায় নিজের বাড়িতে পূজাপাঠ সারছেন শঙ্কর সিংহ। শনিবার। — সুদীপ আচার্য

ভোটের দিনেও এমন ঘরবন্দি কেন?

শঙ্করের স্পষ্ট জবাব, "কার জন্য কাজ করব! কেউ তো আমায় ডাকেনি।"

ডাকার অবশ্য কথাও ছিল না। জেলার একমাত্র কংগ্রেস প্রার্থী অজয় দে-র সঙ্গে তাঁর যা 'সম্পর্ক', তাতে তাঁর হয়ে প্রচারের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তাঁর সমর্থক গোঁজ প্রার্থীরা? অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সিরা যখন খোলাখুলিই গোঁজদের সমর্থনে প্রচার করছেন, তখন শঙ্কর কেন সে পথে হাঁটছেন না? কেন ভোটের দিনেও তিনি ওই প্রার্থীদের তত্ত্বতালাশ নিচ্ছেন না?

শঙ্করের উত্তর, "ওঁরাও আমাকে ডাকেননি। তাই আগ বাড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি।"

কথাটা কেমন যেন শোনাল! শঙ্করের জবাব, "ওই অশ্বত্থামা হত ইতি গজ-র মতো আর কী! এর থেকেই যা বোঝার বুঝে নিন।" আসলে শঙ্কর ভালই বোঝেন তাঁর জেলা নদিয়া এবং অধীরের জেলা মুর্শিদাবাদে দুস্তর ফারাক। মুর্শিদাবাদে অধীরই কংগ্রেস। কিন্তু নদিয়ায় শঙ্করই কংগ্রেস নন। অধীরের অনুগামীরা আশা করেন, তাঁর সমর্থিত নির্দলরা জিততে পারেন। কিন্তু অতি বড় শঙ্কর-ভক্তও জানেন, তাঁর সমর্থিত নির্দলদের জয়ের আশা 'দুরাশা'। শঙ্করও বলেছেন, "নদিয়া আর মুর্শিদাবাদ এক নয়।" তবুও শঙ্কর নির্দল প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছেন। যার প্রধান উদ্দেশ্য: তৃণমূল-স্রোতে আলগা হয়ে আসা নিজের পায়ের তলার মাটি ফের শক্ত করা। সিংহের গর্জন, "এ ভাবে জোট হতে পারে না। বিক্ষুব্ধরা যেখানে আছেন, সেখানে সব হিসেব গোলমাল হয়ে যাবে।"

বস্তুত, এই সিংহ-গর্জনই এখন ভরসা নদিয়ার কংগ্রেস সমর্থকদের। বেলা বাড়তে অতি ঘনিষ্ঠ যে কয়েক জন সমর্থক সিংহবাগানে হাজির, তাঁরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন শঙ্করের এই প্রতিবাদ নিয়েই।

শঙ্কর বলছেন, "আমার ভাইয়ের প্রাণ গিয়েছে সিপিএমের সঙ্গে লড়তে গিয়ে। আমার নিজের শরীরেও অজস্র ক্ষতচিহ্ন। আমাকেই কি না বলছে সিপিএমের দালাল!" একটু থেমে ফের ক্ষোভের উদ্গীরণ, "বলুন তো, কেন অধীরের কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী দেবে? কেনই বা কলকাতায় রাম পেয়ারি রামকে জেতা আসনটি ছাড়া হবে না?

নদিয়াতেও তো আমরা সমান শক্তিশালী। তা হলে কেন সম্মানজনক জোট হবে না?" নেতার কথা শুনে ঘাড় নাড়ছেন সমর্থকেরা।

চাকদহের সিংহ পরিবারের কর্তাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন যে কোনও পরিস্থিতিতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখাই তাঁর স্বভাব। কিন্তু জোটের কথা বলতে গেলেই তাঁর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে 'ছাইচাপা আগুন'। এক সমর্থক শঙ্করের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় জানান, তৃণমূলের নায়ক-সাংসদ তাঁর বিরুদ্ধে কী কী বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন। এ বার অবশ্য আর রাগলেন না। তির্যক হেসে বললেন, "আসলে সরাসরি মেকআপ রুম থেকে রাজনীতিতে এসেছেন তো! ওঁদের তো আর সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি!"

এ সব নিয়েই যে তাঁর বিস্তর ক্ষোভ-অভিমান, তা জানাতে ভুলছেন না শঙ্কর। তিনি বলেন, "সব আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখি। রাজনীতি করতে গেলে আঘাত তো আসবেই! কিন্তু অপমান সহ্য করতে পারি না। আর এ তো বিলো দ্য বেল্ট আঘাত করা হচ্ছে!"

এই সব কথাবার্তার পরে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলে স্নান সেরে গিয়ে বসলেন পুজোর ঘরে। আর পাঁচটা দিনের মতোই। তার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে গিয়ে বসলেন সাদা রঙের স্করপিও গাড়িতে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, "নদিয়ায় না করলেও উত্তর ২৪ পরগনায় প্রচারে যাচ্ছি। জোটটা রাখতে হবে না!" একরাশ শ্লেষ ঝরে পড়ল চাকদহের সিংহের কথায়!

রাজ্যে সীমান্ত এলাকায় অনলাইন নজরদারি কেন্দ্রের

সুপ্রকাশ চক্রবর্তী • কলকাতা

সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিএডিপি)-র কাজেও এ বার অনলাইন-নজরদারি চালু করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

বিধানসভা নির্বাচনে স্পর্শকাতর বুথে কী ভাবে ভোট চলছে, প্রতি মুহূর্তে তার উপর বৈদ্যুতিন নজরদারি চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এটিও হবে খানিকটা তার মতো। ফারাক একটাই। নির্বাচনী নজরদারিতে বাছাই করা বুথের ভিতরের ছবি ফুটে উঠছে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন দফতর ও দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরে। কিন্তু রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্ত লাগোয়া এলাকাগুলিতে কেন্দ্রের দেওয়া বিএডিপি-র টাকায় কোথায় কী কাজ হচ্ছে, তার হিসেব এবং বরাদ্দ টাকার কতটা খরচ হয়েছে, তার খতিয়ান এখন থেকে অনলাইনে ব্লক স্তর এবং জেলা স্তর থেকে পাঠিয়ে দিতে হবে দিল্লিতে। কোথাও কাজ পিছিয়ে পড়লে বা ঢিলেমি ধরা পড়লে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিকেরা জেলাশাসক এবং বিডিও-দের কাছ থেকেই অনলাইনে তার কারণ জানতে চাইবেন।

রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএডিপি-তে অনুমোদিত প্রকল্পগুলি রূপায়ণের দায়িত্ব কোন কোন বিডিও-র উপর থাকছে, ওই খাতে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পাঠানোর সময়ই রাজ্যকে তা জানিয়ে দিতে হবে। তেমনই টাকা খরচের হিসেব পাঠানোর জন্য যে জেলাশাসকেরা দায়বদ্ধ থাকবেন, জানিয়ে দিতে হবে তাঁদের নামও। এখন মহাকরণ থেকে টাকা খরচের খতিয়ান দেওয়া হয় দিল্লিকে। তার অপেক্ষায় না থেকে এ বার সরাসরি জেলাশাসকদের কাছ থেকে বরাদ্দ অর্থের হিসেব বুঝে নেবে কেন্দ্র।

নতুন এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে চলতি ২০১১-১২ আর্থিক বছর থেকে। এই বছর দেশের ১৭টি সীমান্তবর্তী রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে এই প্রথম বিএডিপি-তে সর্বাধিক (১৪৫ কোটি টাকা) বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর আগে এই খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ পেত জম্মু-কাশ্মীর। এ বার জম্মু-কাশ্মীরকে বরাদ্দ করা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে লাগোয়া রাজ্যগুলির ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিতরের এলাকায় রাস্তা, স্কুল-বাড়ি, নিকাশি ব্যবস্থা, কমিউনিটি হল তৈরি করার জন্য বিএডিপি-র টাকা খরচ করা যায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সরাসরি সংশ্লিষ্ট জেলা শাসকদের ওই টাকা বরাদ্দ করে।

চলতি আর্থিক বছরে বরাদ্দের মাপকাঠি নির্ধারণ করতে কেন্দ্রীয় সরকার সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সীমান্তবর্তী এলাকার আয়তন, জনসংখ্যা, রাস্তার দৈর্ঘ্য, গ্রামের সংখ্যা প্রভতি সম্পর্কে বিশদ সমীক্ষা করিয়েছিল। গ্রামের সংখ্যা, জনসংখ্যা, প্রভতির নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সবার উপরে থাকায় এ বার রাজ্যের জন্য অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও হয়েছে সর্বাধিক। ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ সালে বিএডিপি-তে পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৯০ কোটি ও ৯৯ কোটি টাকা।

২০০৮-'০৯ সালে মোট বরাদ্দ ৯০ কোটি টাকার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা খরচের হিসেবই দিতে পেরেছিল পশ্চিমবঙ্গ। সেটাও চলতি আর্থিক বছরে সর্বাধিক অর্থ বরাদ্দ করার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে সরকারি মহল।

চলতি আর্থিক বছরে বিএডিপি-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য পশ্চিমবঙ্গের ৯টি সীমান্তবর্তী জেলার ৬৫টি ব্লক থেকে মোট ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। মুখ্যসচিব সমর ঘোষের নেতৃত্বে রাজ্য স্তরের বাছাই কমিটি তার মধ্যে থেকে উপযুক্ত প্রকল্পগুলি শনাক্ত করে দিল্লির অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। তবে আগামী ১৩ মে বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই কমিটি সে কাজে হাত দেবে বলে আপাতত ঠিক আছে।

কালো টাকা নিয়ে তথ্য জমা দিল সিপিএম

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কালো টাকা ব্যবহার করছে বলে আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের অভিযোগের সমর্থনে শুক্রবার কমিশনের কাছে তথ্য জমা দিয়েছে সিপিএম। সেই তথ্য ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শনিবার জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্ত।

কালো টাকা নিয়ে গৌতম দেবের অভিযোগের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তারই ভিত্তিতে কমিশন সিপিএমকে তাদের অভিযোগের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ জমা দিতে নির্দেশ দেয়। তার পরেই শুক্রবার কমিশনের কাছে তথ্য জমা দিয়েছে সিপিএম। কমিশনে একটি সিডিও জমা দিয়েছেতারা।

পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুতসি অবশ্য এ দিন দিল্লিতে বলেন, "সিপিএমের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি সিডি ক্যুরিয়ারে পাঠানো হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু সেটি এখনও আমাদের দফতরে এসে পৌঁছয়নি। রবিবার কমিশনের দফতর খোলা থাকবে। যদি সিডি আগামিকাল এসে পৌঁছয়, তবে তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"

এর মধ্যেই এ দিন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্ত জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম ভাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তি যাদবপুরের ভোটারদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে টেলিফোনে যাদবপুরের ভোটারদের কেউ নির্দেশ দিচ্ছেন বলে যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী তথা মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এজেন্ট বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কয়েক দিন আগে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। অভিযোগের তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে নির্দেশ দেয় কমিশন। সুরজিৎবাবু যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেখানে এই অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি বলে জানানো হয়েছে। সুনীলবাবু বলেন, "রিপোর্টে ওই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। রিপোর্টের প্রতিলিপি আজই বুদ্ধদেববাবুর নির্বাচনী এজেন্টকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।"

কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা বুদ্ধর

নিজস্ব প্রতিবেদন

যে কংগ্রেস সরকার দেশে ধনী ও গরিব এই দুই শ্রেণির সমাজ গড়েছে, তৃণমূল কংগ্রেস তাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। কংগ্রেস ও তৃণমূল আসলে একই দল। এ ভাবেই শনিবার কংগ্রেস এবং তৃণমূলকে বিঁধলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এ দিন রাজ্যে নির্বাচনী সফরে এসে কাটোয়া এবং দমদমের সভায় বাম সরকারের কাজকর্মের কড়া সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তার পরে সন্ধ্যাতেই দলের জনসভায় তার জবাব দিলেন বুদ্ধদেব।

এ দিন প্রচারে নেমে কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, "কেন্দ্রের আম-আদমির সরকার, আম-আদমির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে! রাজ্যের শিক্ষক, কৃষকরাই তার জবাব দেবেন।" বুদ্ধবাবুর দাবি, কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার কত দিন থাকবে, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে। কংগ্রেস ক্ষমতা হারালে তৃণমূল ফের বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবে বলেও তিনি কটাক্ষ করেন।

এ দিন সন্ধ্যায় কাশীপুর, এন্টালি এবং রাজাবাজারে মুখ্যমন্ত্রীর তিনটি নির্বাচনী সভা ছিল। তার মধ্যে কাশীপুর এবং রাজাবাজারের সভায় প্রধানমন্ত্রীর নাম করেই কেন্দ্রের সমালোচনা করেন বুদ্ধবাবু। এ দিন প্রতিটি সভাতেই বাম সরকারের কাজকর্মের খতিয়ান তুলে ধরেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "আমরা এগিয়ে যাব, না পিছোব, সেটা নির্ণয় করার সময় এসেছে। আমরা জিততে না পারলে রাজ্যের বিপদ।" তাঁর দাবি, বামফ্রন্টের আমলে রাজ্যে শিল্প থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে। তাঁর দাবি, রাজ্যে যেমন ইস্পাত শিল্পে লগ্নি আসছে, তেমনই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও প্রচুর সুযোগ বাড়ছে। বহু ছেলেমেয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কাজ করছেন। রাজারহাটে এই শিল্পে আরও প্রায় দু'লক্ষ ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

কাল প্রচারে রাজ্যে চিদম্বরম

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের পক্ষে প্রচারে রাজ্যে আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। কাল, সোমবার কয়েক ঘণ্টার সফরে রাজ্যে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সভাটি করার কথা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিংয়ের পূর্ব জীবনতলায়। তার পরেই তিনি চলে যাবেন পশ্চিম মেদিনীপুরে। সিপিএমের 'দুর্গ' বলে পরিচিত গড়বেতা এবং কেশপুরে সভা করবেন এই কংগ্রেস নেতা।

রাজ্যের মাওবাদী-প্রভাবিত জঙ্গলমহলের 'অতি-স্পর্শকাতর' যে ১৪টি কেন্দ্রে ভোট হবে সব শেষে, তার মধ্যেই রয়েছে গড়বেতা। ক্যানিং পূর্ব, গড়বেতা এবং কেশপুর—এই তিনটি আসনেই সিপিএম প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই কংগ্রেস প্রার্থীর। সকাল ন'টা নাগাদ রাজ্যে পৌঁছবেন চিদম্বরম। হেলিকপ্টারে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁর পৌঁছনোর কথা ক্যানিংয়ে। তার পরে সাড়ে ১২টা নাগাদ গড়বেতা এবং সব শেষে আড়াইটে নাগাদ কেশপুরে পৌঁছবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিকেলে তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা। কংগ্রেসের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্ব শনিবারই দুই জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে সভার ব্যাপারে জানিয়েছেন। রাজ্য এবং দুই জেলার প্রশাসন সভার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপরতা শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে বলানো হল, পাল্টা বললেন সোমনাথ

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্য সফরে এসে যে ভাবে নানা ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের কাজ নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তার পাল্টা সমালোচনা করলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি 'ব্যক্তিগত ভাবে' শ্রদ্ধা করেন বলে জানিয়েই সোমনাথবাবুর মন্তব্য, "ওঁকে দিয়ে এই সব কথা বলানো হয়েছে!"

বালিগঞ্জের সিপিএম প্রার্থী ফুয়াদ হালিমের সমর্থনে শনিবার সন্ধ্যায় এক জনসভায় সোমনাথবাবু বলেন, "প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি শ্রদ্ধা করি। ওঁকে দিয়ে এ সব কথা বলানো হয়েছে। কী ধরনের মিথ্যা, আপনারা তো বুঝতেই পারছেন!" শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ভূমি সংস্কার পর্যন্ত বামফ্রন্ট জমানার নানা সাফল্যের তথ্য এবং উদাহরণ দিয়ে সোমনাথবাবু দাবি করেন, মানুষের জীবনে প্রকৃত 'পরিবর্তন' বামফ্রন্টই এনেছে। তারই পাশাপাশি সোমনাথবাবুর মন্তব্য, "তবে আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষ যদি ভোট দিয়ে পরিবর্তন আনতে চান, তা হলে আনবেন! সেটাই গণতন্ত্র।"

বস্তুত, প্রয়াত জ্যোতি বসুর ঢঙে মৃত্যুর আগে বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় ফেরানোর আর্জি জানিয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার। সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হলেও তিনি যে 'বামপন্থী'ই আছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক বিচারধারা বদলায়নি, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সোমনাথবাবু এ দিন বলেন, "শরীর ভাল নেই, বেশি দিন আর বাঁচব না। জ্যোতিবাবুর মতো করেই বলতে চাই, মৃত্যুর আগে অষ্টম বামফ্রন্ট দেখে যেতে চাই!"



অসুস্থ গৌতম

এন্টালি কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী দেবেশ দাসের সমর্থনে ট্যাংরার শীল লেনে একটি সভায় বক্তৃতা করার কথা ছিল তাঁর। তিনি আসবেন বলে অপেক্ষমান শ্রোতাদের মধ্যে উৎসাহও ছিল ব্যাপক। চেয়ার-মাঠ ভরে গিয়েছিল। কিন্তু এলেন না রাজ্যের আবাসন মন্ত্রী তথা সিপিএমের 'ঘুরে দাঁড়ানোর কাণ্ডারী' গৌতম দেব। দলের আরেক নেতা বিনয় কোঙার বক্তৃতা করতে উঠে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এই বলে, "ও আসতে পারছে না। আমি বিকল্প হিসাবে বলতে এসেছি।" বিনয়বাবুর পর বক্তৃতা করেন প্রার্থী দেবেশবাবু। সভার শেষে ঘোষণা করা হয়, গৌতমবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাঁটতে পারছেন না। তাই আসতে পারেননি।


মুড়ি-মিছরি বাছাবাছি

বিধানসভা ভোটের প্রচারে যে সমস্ত ভিভিআইপি রাজ্যে আসছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে মেডিক্যাল টিম দিতে হয়। এটাই প্রোটোকল। তা মেনে প্রতিটি টিমেই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর স্তরের চিকিৎসকদের রাখা হচ্ছে। আর তাতেই বেঁকে বসেছেন এসএসকেএমের বেশ কয়েক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার। তাঁদের দাবি, তাঁরা পদমর্যাদায় উপরের সারিতে। অতএব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বা লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো 'হেভিওয়েট'দের মেডিক্যাল টিমে তাঁদের রাখতে হবে। আর অন্য নেতা-নেত্রীদের মেডিক্যাল টিমে রাখা হোক রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের। না হলে নাকি 'মুড়ি-মিছরির এক দর' হয়ে যাচ্ছে। ওই চিকিৎসকদের দাবিমতো মেডিক্যাল শিক্ষা অধিকর্তা সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যভবন জানিয়েছে, বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।


অনশনে রাহুল

প্রশাসনের একাংশকে ব্যবহার করে তৃণমূল তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে—এই অভিযোগ তুলে তার বিহিতের দাবিতে রাজ্য নির্বাচন দফতরের সামনে 'আমরণ অনশন'-এ বসেছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি অনশন শুরু করেন। রাহুলের বক্তব্য, "আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভোটের প্রচারে আসছেন। তাঁদের সফরসূচি বহু আগেই প্রশাসনকে জানানো হচ্ছে। অথচ তাঁদের হেলিকপ্টার নামার মাত্র এক ঘণ্টা আগে, কখনও সভার নির্ধারিত সময়ের পরে প্রশাসনিক অনুমতি মিলছে। আসলে বিজেপি-র প্রচার তুঙ্গে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করছে তৃণমূল। তারাই প্রশাসনের একাংশকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে। তাই প্রচারসভার ক্ষতি করেও অনশনে বসতে বাধ্য হলাম।" উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসক এবং উলুবেড়িয়া থানার আইসি-কে সাসপেণ্ড করার দাবি জানিয়েছেন রাহুল। তাঁর দাবি, নির্বাচন কমিশনকে আশ্বাস দিতে হবে, এর পর কোনও বিজেপি নেতার প্রচারে অনুমতি দিতে প্রশাসন গড়িমসি করবে না।


বিধিভঙ্গে বাজেয়াপ্ত

সিপিএম এবং তৃণমূল—দু' দলের প্রচারেই ব্যবহার করা হচ্ছিল পারমিট-বিহীন গাড়ি। খবর পেয়ে পুলিশকে সেই গাড়ি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিলেন বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার সুশান্ত চক্রবর্তী। ঘটনাটি ঘটেছে পাত্রসায়র থানার ধারাবাড়ি এবং বিষ্ণুপুর থানার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে। শনিবার সুশান্তবাবু বলেন, "তৃণমূল পাত্রসায়র থানার ধারাবাড়ি গ্রামে প্রচার মিছিলে পারমিট ছাড়াই দু'টি বাস ব্যবহার করে। বিষ্ণুপুর থানার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে সিপিএম প্রচার-মিছিলে ব্যবহার করেছে পারমিট-বিহীন একটি গাড়ি। দু'টি ঘটনাতেই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে দু'দলকেই।"


ঘেরাও অভিজিৎ

নলহাটির একটি বুথে বাম-বিজেপির বিক্ষোভের মুখে পড়লেন নলহাটির কংগ্রেস প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। শনিবার সকালে তিনি নলহাটির ভবানন্দপুর গ্রামে যান। বুথ থেকে কিছু দূরের মাঠে তিনি একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখন সিপিএম, ফব ও বিজেপি সমর্থকরা তাঁকে ঘিরে অভিযোগ করে, ভোটের দিনেও অভিজিৎবাবু এলাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে প্রচার করছিলেন। এতে নির্বাচনী বিধিভঙ্গ হয়েছে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়।

মানবিক মুখ হাওড়ায়

লঞ্চ থেকে লাফ মেরে উদ্ধার ডুবন্ত মহিলাকে

দেবাশিস দাশ

হাওড়া সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের এক মহিলা। তাই দেখে ঘাটে বসে থাকা এক যুবক তড়িঘড়ি লঞ্চে উঠে ঘটনাস্থলে পৌঁছে মাঝ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তার পর ওই ডুবন্ত মহিলাকে উদ্ধার করে আনেন। অচৈতন্য মহিলাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় লঞ্চঘাট থেকে ট্যাক্সিতে তুলে হাওড়া হাসপাতালে নিয়ে যান অন্য দুই পথচারী। হাসপাতালের সুপার শুভ্রাংশু চক্রবর্তী পরে বলেন, "মহিলা ভাল আছেন। চিকিৎসা চলছে। শরীরের কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।"

বছর দুয়েক আগে অসুস্থ হয়ে পথের ধারে পড়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় দুই বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু দেখেছিল হাওড়া। শনিবার দেখল অন্য এক মানবিক মুখ।

গীতা মহেশ্বরী

রাকেশ লাল

ঘটনার সূত্রপাত শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায়। পুলিশ জানিয়েছে, সল্টলেকের সেক্টর তিন-এর বাসিন্দা গীতা মহেশ্বরী (৪৫) আচমকা সেতুর মাঝখান থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। ওই সময় গঙ্গার স্নান করবেন বলে চাঁদমারি ঘাটে বসেছিলেন বারাণসীর বাসিন্দা রাকেশলাল যাদব। তাঁর কথায়, "আমি ভোজপুরি ভাষায় গান লিখি। সকালে ঘাটে বসে মা গঙ্গাকে নিয়ে একটা গান লেখার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি, সেতু থেকে কিছু একটা ঝপাং করে গঙ্গায় পড়ল। স্থানীয় মানুষের চিৎকার শুনে বুঝলাম, এক জন মহিলা ঝাঁপ দিয়েছেন। আমি দৌড়ে চলে যাই পাশের হাওড়া লঞ্চঘাটে। তখন একটা লঞ্চ ছাড়ছিল। লাফ দিয়ে উঠে পড়ি সেটিতে। এর পর কাছাকাছি গিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে ওই মহিলাকে উদ্ধার করি।"

বছর পঁচিশের ওই যুবক জানান, ঝাঁপ দিলেও বাঁচার জন্য ওই মহিলা তখন নিজেই সাঁতরে পাড়ে আসার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। তাঁকে আঁকড়ে ধরে টানতে টানতে পাড়ে নিয়ে গিয়ে তুলি। এর পর লঞ্চ কর্মীদের সাহায্যে ওই মহিলাকে জেটির ওপর তুলে শুইয়ে দেওয়া হয়। তিনি তখন অচৈতন্য।

যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন সেতুর ওপর দু'টি আলাদা বাসে ছিলেন উত্তরপাড়ার বাসিন্দা অরুণ রায় ও মধ্য কলকাতার শুভঙ্কর ঘোষ। অরুণবাবু রাতের ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। শুভঙ্করবাবু জরুরি কাজে কলকাতা থেকে হাওড়ায় যাচ্ছিলেন। দু'জনেই হইচই শুনে বাস থেকে নেমে পড়েন। সেতুর রেলিং থেকে উঁকি মেরে দেখেন, এক জন বার বার ভেসে উঠে ফের ডুবে যাচ্ছেন। তাঁরা সাহায্য করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। কিছু ক্ষণ পরে তাঁরা দেখেন, একটি লঞ্চ থেকে এক ব্যক্তি ঝাঁপ দিয়ে ওই মহিলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

শুভঙ্করবাবু বলেন, "লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখি ওই মহিলাকে জেটিঘাটে তোলা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞান নেই। অবস্থা খারাপ বুঝে আমি আর দেরি করিনি। একটা ট্যাক্সি ডেকে অরুণবাবুর সাহায্যে ওঁকে তুলে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাই।" হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত অরুণবাবু বলেন, "আমি ওই মহিলার সালোয়ারের পকেট থেকে একটা টেলিফোন নম্বর পেয়ে বাড়ির লোককে ফোন করি। পরে বাড়ির লোক জন আসেন।"

অরুণবাবুর ফোন পেয়ে সল্টলেক থেকে হাসপাতালে যান গীতাদেবীর বড় ভাসুর ভরত মহেশ্বরী এবং অন্য আত্মীয়েরা। ভরতবাবু জানান, তাঁরা চার ভাই। সকলেরই পৃথক ব্যবসা। গীতাদেবী তাঁর ছোট ভাই অনিলের স্ত্রী। ছোটভাই পোলিও আক্রান্ত। কাজকর্ম বিশেষ করতে পারেন না। ওঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে।

কিন্তু কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন গীতাদেবী? ভরতবাবুর কথায়, "কয়েক দিন ধরেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি চলছিল। তার জেরেই মনে হয় গীতা এটা করে ফেলেছে। তবে যাঁরা ওঁকে বাঁচিয়েছে তাঁদের ঋণ আমরা কখনও শোধ করতে পারব না।"

গীতাদেবীর প্রাণ বাঁচাতে পারলেও মা গঙ্গাকে নিয়ে গান লেখা অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি রাকেশ লালের।

নির্দল-কাঁটা আর মুসলিম ভোটে ছায়া পুরভোটেরই

ক বছর আগের পুরভোটই যেন ফিরে এসেছে কলকাতা বন্দর তল্লাটে!

সেই পুরভোটের মতোই ত্রিমুখী লড়াই। দুই কেন্দ্রে ত্রিমুখী লড়াইয়ের ছ'জন সৈনিকের মধ্যে চার জনই কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর! সেই পুরভোটের মতোই ওয়ার্ড ধরে ধরে যুদ্ধের হিসাব কষতে হচ্ছে তিন শিবিরকেই।

কিন্তু পুরভোটের সঙ্গে বৃহত্তম এবং সব চেয়ে 'তাৎপর্যপূর্ণ' তফাতটা এখানেই যে, কলকাতা বন্দর ও মেটিয়াবুরুজের জোড়া কেন্দ্রে এ বার হাত চিহ্নটাই নেই! দু'টি কেন্দ্রই নতুন। এবং পুরনো কেন্দ্রের দুই বিধায়ক রাম প্যায়ারে রাম ও আব্দুল খালেক মোল্লা কংগ্রেসের টিকিট না-পেয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। দলের শাস্তির হুমকির পরোয়া না-করেই! সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ভোট এবং নির্দল-কাঁটা, এই দুই প্রশ্নই কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পিঠোপিঠি দুই কেন্দ্রের লড়াইকে আকর্ষণীয় করেছে।

কংগ্রেসের বর্তমান বিধায়কদের টিকিট না-দিয়ে আসন দু'টি 'ছিনিয়ে' নেওয়ার পরে স্বভাবতই দুই কেন্দ্র তৃণমূলের কাছে সম্মানের লড়াই। কলকাতা বন্দরে মেয়র পারিষদ, তৃণমূলের ফিরহাদ (ববি) হাকিমের কাছে সম্মানের প্রশ্নটা আরও বেশি, কারণ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রকে 'নিষ্কণ্টক' করতে হবে তাঁকে! ববি অবশ্য টেনশনে নেই মোটেই। প্রচার শেষে তাঁর নিয়মমাফিক 'পর্যালোচনা' বৈঠক করার ফাঁকে বলছেন, "গত পুরভোটে এই এলাকায় কংগ্রেস ১৮% ভোট পেয়েছিল। কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটটা আসে হাত চিহ্নে। রামের সঙ্গে হাত নেই, তিনি ওই ভোট পাবেন না!"

'জোড়া মোমবাতি'র রাম দাবি করছেন, "আমি তো বলছি, কংগ্রেসকে বাঁচাতে নির্দলকে ভোট দিন! তৃণমূলের চাপে পড়ে কংগ্রেসের কিছু নেতা হয়তো এই সমঝোতা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেসকে উড়িয়ে দেওয়া অত সহজে সম্ভব হবে না! ১৯৬২ থেকে রাজনীতিতে আছি। কোনও দিন দল পাল্টাইনি, পাল্টাবও না! কংগ্রেসের কথা ভেবেই লোকে আমাকে ভোট দেবে!"

দাবি যা-ই করুন, রামের কাজ অত 'সহজ' নয়। ববির যেমন সহজ যুক্তি, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, এ বারের ভোটটা এই প্রশ্নে। এখানে নির্দল বা অন্য কিছু চলবে না!" এটা যেমন এ বারের রাজনৈতিক মেরুকরণের যুক্তি, তেমনই এলাকাগত বিন্যাসও রামের খুব একটা পক্ষে নয়। তিন বারের বিধায়ক তিনি কিন্তু গার্ডেনরিচ এলাকা তাঁর কেন্দ্রে নতুন। গত পুরভোটে ৭৯ ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড জিতেছিলেন রাম নিজে এবং তাঁর স্ত্রী হেমা রাম। সে দু'টোও জেতা মাত্র ৩০০ এবং ৭০০-র কাছাকাছি ভোটে। মাঝে 'আর পি আর' (রামের নামের আদ্যক্ষর) লেখা তেরঙা পতাকাও উড়তে বেশি দেখা যাচ্ছে খিদিরপুর এলাকাতেই। রাম যদিও বলছেন, "লোকে জানে রাম প্যায়ারের ঘরে কোনও দরজা নেই! হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-বিহারি সবাই আমাকে একই রকম ভালবাসে। চেতলা থেকে আসা ওই ভদ্রলোককে (ববি) দিয়ে ও'সব হবে না!" ববি পাল্টা বলছেন, "ওই দু'টো ওয়ার্ডে তো কাজই হয়নি! চাপে পড়ে এখন জাতপাত নিয়ে আসছেন!" বেকারি আর অনুন্নয়নের জাঁতাকলে আটকে-থাকা বন্দর এলাকায় উর্দু, হিন্দি, বাংলা— তিনেই সাবলীল রাম তাঁর 'কাছের মানুষ' ভাবমূর্তি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, নাকি চেতলা থেকে এসে ববিই সেখানে বাজিমাত করেন, প্রশ্নটা সেই জায়গায়। এবং সেখানে ববির মাথার উপরে স্বয়ং মমতার হাত আছে, রামের হাতে মোমবাতি!

বন্দর পেরিয়ে মেটিয়াবুরুজে ঢুকলে তৃণমূলের কাজ আবার খুব 'সহজ' নয়। বন্দরে যেমন ৬০% মুসলিম ভোট এবং তার সংখ্যাগরিষ্ঠই উর্দুভাষী, মেটিয়াবুরুজে মুসলিম ভোটের হার তেমনই ৭০%-এর বেশি এবং তার মধ্যে বাংলাভাষী যথেষ্ট। মেটিয়াবুরুজের মুসলিম জনসংখ্যার ৮০%-ই আবার পেশায় ওস্তাগর বা দর্জি। প্যাঁচটা সেখানেই।

রেডিমেড পোশাক শিল্পের উপরে এ বারের বাজেটে ১০% উৎপাদন শুল্ক চাপিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, যার শরিক তৃণমূল। জীবিকায় টান পড়ার আশঙ্কায় ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছে ওস্তাগর সম্প্রদায়। সেই প্রতিবাদের ঢেউয়ে চাপতে চাইছেন খালেক, সিপিএম-ও। খালেক বলছেন, "আমি তো বলেইছিলাম, প্রণবদা (কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়) শুল্ক তুলে নিলে আমি মনোনয়ন তুলে নেব। উনি তোলেননি, আমিও তুলিনি!"

শুল্ক-প্রশ্নেই অশনি সঙ্কেত দেখেছে তৃণমূল। কংগ্রেসের 'দায়' পাছে তাদের ঘাড়ে চাপে! তারা রাতারাতি একটা 'দাওয়াই' বার করেছে! তৃণমূল প্রার্থী, ১৪০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমতাজ বেগমের কথায়, "এটা নিয়ে আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম। কালীনগর মাঠে সভা করতে এসে মমতাদি ফোনে প্রণববাবুর সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে দিলেন, ওই শুল্ক বাতিল করে দেওয়া হবে। ভোটের আচরণবিধি আছে বলে ঘোষণা করলেন না কিন্তু বললেন, ওটা উঠে যাবে। সংসদ খুললে।" অর্থাৎ, ঘোষণা করলেন না, কিন্তু করলেন!

সিপিএম অবশ্যই এতে ভোলার নয়! মমতার ফোনের ও'পারে আদৌ প্রণববাবু ছিলেন বলেই তারা বিশ্বাস করতে নারাজ! মহেশতলা এলাকা (যার ৯টা ওয়ার্ড মেটিয়াবুরুজে পড়ছে) ঘুরে এসে দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলছেন, "তৃণমূল এ বার মুসলিম ভোট পেয়ে গিয়েছে ধরে নিয়ে থাকলে ভুল করবে। এই উৎপাদন শুল্কের প্রশ্নটাকে নিজেদের জীবিকার সমস্যা হিসাবেই দেখবেন মুসলিমেরা।" গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ জোনাল সম্পাদক নারায়ণ সরকার একটু সংশয়ী, "তৃণমূল নেত্রী একটা চমক দিয়ে গিয়েছেন তো! কী হয় বলা যায় না!"

ক্রিকেট ব্যাট চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন খালেক। তাঁর ব্যাটে রানও আছে। গত বার মহম্মদ আমিনকে গার্ডেনরিচে হারিয়ে দিয়েছিলেন এই খালেক। মমতা নিয়মিত বলছেন, নির্দলদের ভোট দিয়ে লাভ নেই কারণ তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। খালেক তার জবাবে বলছেন, "বামফ্রন্টের জমানায় যদি আমি বিরোধী বিধায়ক হয়ে কাজ করতে পারি, নির্দল হয়েই বা পারব না কেন? এলাকায় কংগ্রেস বলতে লোকে আমাকেই বোঝে। তৃণমূলের প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ থাকায় ওদেরও কিছু ভোট আমি পাব।" তৃণমূল প্রার্থী মমতাজ পাল্টা বলছেন, "সিপিএমের লোকেরা ওঁর দেওয়াল লিখে দিচ্ছে, খেটে দিচ্ছে। সিপিএম চায় খালেক ভোট পান!" বটতলায় খালেকের বিধায়ক কার্যালয়ে আগের মতো ভিড় অবশ্য নেই।

এই গোটা পরিস্থিতিই দুই বাম প্রার্থীর দিক থেকে রাজনৈতিক শিবিরের নজর সরিয়ে দিয়েছে। তাঁরা দু'জনও চাইছেন চুপচাপ 'কাজ' হাসিল করতে। একবালপুরের বাড়ি-কাম-নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে বন্দরের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী মইনউদ্দিন শামস বলছেন, "রাম ১৫ বছর বিধায়ক থেকেও এলাকার উন্নয়ন করতে পারেননি। এখন উনি আর তৃণমূল প্রার্থীর লড়াই হচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হওয়ার জন্য! লোকে এ বার আমাকে সুযোগ দেবেই!" পাহাড়পুরের দলীয় কার্যালয়ে বসে মেটিয়াবুরুজের সিপিএম প্রার্থী, ১৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বদরুদ্দোজা মোল্লা বলছেন, "খালেকের অনেক লোক তৃণমূলে গিয়েছেন। তা তৃণমূল মানেই যে বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য, আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি, এটা মানুষকে বোঝাচ্ছি।" বদরুদ্দোজাদের বার্তা খুব পরিষ্কার— তৃণমূল এলেই বন্দর এলাকায় ফের সমাজবিরোধীদের দাপট বাড়বে। অতএব ভাইসব, সাবধান! রাজনীতির বার্তাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন নারায়ণবাবু, "কংগ্রেসের ভোটটা তিন ভাগ হয়ে খালেক, তৃণমূল আর আমরা পাব। আমাদের ভোট বাড়বে।"

২০১০-এর পুরভোট এই রকমই সব আগাম হিসাব উল্টে দিয়ে কলকাতা এবং শহরতলির মুসলিম মহল্লায় জোড়া ফুল ফুটতে দেখেছিল। ২০১১ পুনরাবৃত্তি দেখবে?

বোমা ফাটলো না, চলল না গুলি

শান্তির অবাধ ভোটই দেখল 'সন্ত্রস্ত' অঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদন

তিহ্যের পরিবর্তন। এবং প্রত্যাবর্তনও বটে।

'পরিবর্তন' কোথায়? চলুন বীরভূমের নানুরে।

সকাল থেকে বুথের সামনে দীর্ঘ লাইন। রোদ মাথায় করে হাতে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে শয়ে শয়ে পুরুষ-মহিলা। আধাসেনার টহল। বুথের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারছে না অবাঞ্ছিত কেউ। ঘন ঘন বোমার আওয়াজে চমকে উঠতে হচ্ছে না। মাস্কেট থেকে ছিটকে আসছে না গুলি। দিনের শেষে ভোট পড়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। রক্ত ঝরা তো দূরের কথা, একটা বোমা-গুলির শব্দও ভেসে আসেনি। এ এক অচেনা নানুর।

ইলামবাজারে কড়া পাহারায় ভোট। — বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

চলুন মুর্শিদাবাদের ডোমকলে।

তিন বছর আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই এলাকাই সাক্ষী ছিল ১৪টি খুনের। নিবার্চনের আগের রাতে যেখানে বোমা বাঁধতে গিয়ে মারা গিয়েছিল পাঁচ যুবক। নির্বাচনকে ডোমকল চেনে 'খুনে-ভোট' নামে। অথচ মুর্শিদাবাদের সেই জনপদ শনিবার ছিল প্রায় ঘটনাহীন।

নদিয়ার গয়েশপুর কিংবা বহিরগাছি, লোকমুখে যার পরিচয় 'রিগিং জোন', নির্বিঘ্ন নির্বাচনের সকালে অচেনাই লেগেছে তাকেও।

বীরভূম, মুর্শিদাবাদ আর নদিয়ার সন্ত্রাস দীর্ণ এলাকাগুলিতে ২০১১-এর নির্বাচন তাই বাস্তবিকই ঐতিহ্যের 'পরিবর্তন' দেখল।

আবার ঐতিহ্যের 'প্রত্যাবর্তন'ও ঘটেছে।

বিপুল ভোট দেওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে দক্ষিণবঙ্গের এই তিন জেলাই। পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের মতোই ২০১১-তেও গড়পড়তা ভোটের হার প্রায় একই (যে ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম হয়নি ২০০৮-এর পঞ্চায়েত এবং ২০০৯-এর লোকসভাতেও)। ৮৬ শতাংশ। বীরভূমে গত দশ বছরের সর্বাধিক ভোট পড়েছে এ বার, ৮৫.৪৮ শতাংশ। তবে, ২০০৬ (৮২.৪৩) এবং ২০০৯ (৮২.৭২)-এর নির্বাচনেও ভোটের হার ছিল প্রায় এক। ভোটের গড় ধরে রেখেছে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদও। শনিবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবরে ওই দুই জেলায় ভোটের হার একই— ৮৬ শতাংশ।

সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে ওই তিন জেলায় এ বার আসন সংখ্যা ৪৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০টি। ২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ৩৬টি আসন গিয়েছিল বামেদের দখলে। কিন্তু ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হার প্রায় একই থাকলেও প্রবল ভাবে পিছিয়ে পড়ে বামেরা। বিধানসভা কেন্দ্রের হিসেব ধরলে জোট প্রার্থীরা সেই নির্বাচনে এগিয়ে ছিল অন্তত ৪৩টি আসনে। বামেরা এগিয়েছিল মাত্র ৭টিতে।


স্ত্রী চিত্রলেখার সঙ্গে অভিজিৎ
মুখোপাধ্যায়। শনিবার নলহাটির একটি

ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে।— সব্যসাচী ইসলাম

এ বার কী হবে? পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দু'পক্ষই বুক বাঁধছে আশায়। '০৯-এর মতো 'পরিবর্তনের' হাওয়া অটুট থাকবে বলে মনে করছেন বিরোধীরা। আবার বামেরা দেখাচ্ছেন '০৬ সালের হিসেব। যুক্তি দিচ্ছেন, বিপুল ভোট মানে বিরোধীদের পাল্লা ভারী— সব ক্ষেত্রে তাই এমনটা ভাবার কারণ নেই। তাঁদের হিসেব, ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তিন জেলায় গড়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোট পড়লেও তাঁদের ঝুলিতে গিয়েছিল ৩৬টি আসন।

অর্থাৎ, বিপুল ভোট পড়ার নিরিখে বাম এবং বিরোধী, উভয়েই তাদের 'চেনা' সম্ভাবনার খোঁজ করছেন। কিন্তু এ বার সেটা কীসের ইঙ্গিত, সে প্রশ্ন থাকছেই।

সিপিএমের বীরভূম জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "ভোটার বেড়েছে। তাই ভোটও বেশি পড়েছে।" সেটা কীসের ইঙ্গিত? খোলসা করতে চাননি তিনি। তবে, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও কংগ্রেসের জেলা সভাপতি অসিত মাল স্পষ্টতই আশাবাদী। তাঁরা দু'জনেই বলছেন, "মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।" মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও সাংসদ অধীর চৌধুরীও বলছেন, "ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এ বার কংগ্রেস ভাল ফল করবে।" তবে এই প্রশ্নে ঈষৎ অস্বস্তিতে নদিয়ার জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহ। অবাধ ভোট পড়েছে মেনে নিলেও তা যে জোট প্রার্থীদের দিকেই যাবে, সে কথা নিশ্চিত করে বলছেন না তিনি। বলেছেন, "পরিবর্তনের হাওয়া আছে। কিন্তু জোট প্রার্থীর া ওইভোট কতটা টানতে পারবেন, সেটাই প্রশ্ন।"

বিপুল ভোট নিয়ে দলীয় নেতাদের সংশয় থাকলেও 'অবাধ' ভোটের অচেনা ছবিতে কিন্তু সকলেই স্বস্তিতে। মুর্শিদাবাদের সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ মইনুল হাসান তাই বলেন, "মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় বিনা রক্তপাতে ভোট হল, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।"

ডোমকলের গড়াইমারি, কুচিয়ামোড়া কিংবা ঘোড়ামারার মতো গ্রামগুলিতে ঘুরেও প্রতি পদে সেই স্বস্তিই চোখে পড়েছে। নদিয়ার গয়েশপুর কিংবা বহিরগাছির মানুষও


নানুরের সাকুলিপুরে ভোট দিলেন
নিহত সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাসের

স্ত্রী হাসি দেবী।— সোমনাথ মুস্তাফি

নিশ্চিন্তে ভোট দিয়ে এসে বলছেন, "ভোট হল অথচ রিগিং হল না, ভাবতেই পারছি না!" প্রায় ১৭ বছর পরে ভোট দিলেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের গিরিয়ার বাসিন্দারা। তাঁদের অনেককেই বলতে শোনা গিয়েছে, "এত দিন আমাদের ভোট তো 'দাদারা'ই দিয়ে দিতেন। এ বার নিজেরা দিলাম।"

পাপুড়ি, হাড়মুড়ের মতো নানুরের 'সন্ত্রস্ত' গ্রামগুলিতেও গিয়ে দেখা গিয়েছে, হাসিমুখে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মানুষ। নানুরের এই 'পরিবর্তনের' প্রধান কারণ? স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়ি এবং আধাসেনার উপস্থিতি। এই 'অ-হিংস' ভোটের নেপথ্যে অন্য কারণও আছে বলে স্থানীয় মানুষ মনে করেন। নানুরের খুজুটিপাড়া এলাকায় এত দিন নির্বাচন পরিচালনা করতেন সিপিএমের যে তা-বড় নেতারা, তাঁরা এখন হাজতে। নানুরের নির্বাচন একা হাতে 'সামলাতেন' স্থানীয় সিপিএম নেতা নিত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। সুচপুর-গণহত্যা মামলায় সেই নিত্যনারায়ণবাবু-সহ ৪৪ জন দলীয় কর্মীর যাবজ্জীবন হয়েছে। সকলেই এখন জেলে। নানুরও তাই 'শান্ত'। নানুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস এবং সিপিএম কর্মী অভিরাম দাস হত্যায় শেখ জামু-সহ ১০-১২ জন তৃণমূল কর্মী জেলে। শান্ত নানুরেও কিন্তু থাকতে ভরসা পান না নিহত আনন্দ দাসের স্ত্রী হাসিদেবী। তিনি এসেছেন, ভোটও দিয়েছেন। ফেরার পথে বলেছেন, "আর যাই হোক ছেলেমেয়েকে রাজনীতি করতে দেব না।"

এ-ও কি এক পরিবর্তন!

(তথ্য: সুজাউদ্দিন, বিমান হাজরা, সুস্মিত হালদার, অর্ঘ্য ঘোষ)

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcom

Website counter

Census 2010

Followers

Blog Archive

Contributors