Indian Universities lag behind as Khulna university latest research exposes the death knell set for Sundarbans.
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় : মহাসংকটে সুন্দরবন
নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান, ইন্ডিপেডেন্ট টিভির সাংবাদিক সুলতানা রহমানসহ সরকার সমর্থক যারা বলেছিলেন শ্যালা নদীতে সাদে তিন লাখ লিটার তেল হলো নস্যি।
কাউন্টার ফটোর আলোকচিত্রী রেজা শাহরিয়ার রহমানের এ ছবিটি ন্যাশনাল জিউগ্রাফি থেকে নেয়া।
ইহাতে সুন্দরবনের আসলে শীতকালে গা গরম হয়েছে। ইহাতে সুন্দরবনের কেন ওই নদীতেও কিছু হয়নি। বাঘ, হরিণ, কুমির, ডলফিনের ক্ষতিতো দুরের কথা, সুন্দরবনের তেল ডুবিতে কাকড়া-শামুকের ক্ষতি করতে পারেনি। সেইসব মানুষের জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটি নিঃসন্দেহে বড় ধরনের ধাক্কা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এই দুর্যোগে বিশাল কাজ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজটি করেছে সেটাই আসলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু আফসোস। আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক শব্দটি উপড়ে পেলে সেখানে করপোরেট স্বার্থ যুক্ত করে কাজ করা হচ্ছে। সেই আলাপ ও আলোচনা অন্য আরেকদিন করা যাবে। তবে তার আগে আসি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সুন্দরবনের উপর সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে। এই গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
প্রথম থেকেই বলছিলাম, খালি চোখে দেখা সম্ভব নয় আসলে সুন্দরবনে কি ঘটেছে এই তেল পড়ার পর। কারণ তেলের জটিল রাসায়নিক কী ঘটাতে পারে তা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য এ বিষয়ে লেখা আরেকটি ব্লগে সেই আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছিলাম।
শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফারনেস তেল ট্যাংকার ডুবে ছড়িয়ে পড়ে মহাসর্বনাশ ঘটিয়েছে সুন্দরবনের। ভারি এই তেলের কারণে নদী ও বনের প্রাণ প্রতিবেশ মারাÍক হুমকির মুখে পড়েছে। তেলের কারণে পানির ভেতর ডিম, রেনুপোনা, জলজপ্রাণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে। যার
তিনি বলেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে বর্তমানের শ্যালা নদীর নৌ রুটটি বাতিল করতে হবে। এর পাশাপাশি কোনভাবেই সুন্দরবনের কোনস্থান দিয়েই তেলবাহী ও কয়লাবাহী কোন জাহাজ নেওয়া যাবেনা। তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকর। যদি কোন কয়লাবাহী জাহাজ এখানে ডুবে যায় তার ক্ষতি কোনভাবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না বলেও তিনি জানান।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল তেল নি:সরনের দিন থেকেই সুন্দরবনের ১২'শ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে তেলের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ টিমে অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক প্রসূন কুমার ঘোষ ও সহকারি অধ্যাপক আলী আকবর। এ ছাড়া সাতক্ষিরা শহীদ স্মৃতি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। এ টিমে অন্য সাতজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকায় তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি ৪৮ ঘন্টা পর পর এ গবেষণার তথ্য উপাত্য নেওয়া হয়েছে। ১২'শ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৫টি স্থান থেকে এ তথ্য গবেষণা নেওয়া হয়েছে। গত ১১, ১৩, ১৫, ১৭, ১৯, ২১, ২৩ ও ২৫ ডিসেম্বর মোট আট দিন এই গবেষণার জন্য তথ্য উপাত্য সংগ্রহ করা হয়েছে। একই সময় যেখানে তেল নি:সরণ হয়নি পশ্চিম সুন্দরবনের ঘড়িলাল, জোড়া সিং ও কলাগাছিয়াতে তথ্যা উপাত্য সংগ্রহ করা হয়। যেখানে তেল নি:সরণ হয়েছে সেই পূর্ব সুন্দরবন শ্যালা নদী ও তেল নি:সরণ হয়নি পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্যে এই তুলনায় করে গবেষণার ফল বেরা করা হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, তেল নি:সরনের ফলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্রে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদি। এ গবেষণাটির তত্বিয় মডেল নেওয়া হয়েছে আমেরিকান পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন (এপিএইচএ) এর দেওয়া মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এই গবেষক দলটি আগামি এক বছর সুন্দরবনের ওপর গবেষনা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন।
সুন্দরবনের ওপর বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে ৩০০ থেকে ৪০০টি উদ্ভিদকণা এবং ২০ থেকে ৩০টি প্রাণিকণা থাকে।
খুবির এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের এ গবেষণায় দেখা গেছে পানির অভ্যন্তরে ফারনেস তেলের কারণে এসব উদ্ভিদকনা ও প্রাণিকনার মারাÍক ক্ষতি হয়েছে। ফাইটো প্লানটন হলো জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক। সাভাবিক পরিবেশে পানিতে ৪৫টি প্রজাতির ফাইটো প্লানটন সুন্দরবনের নদীতে পাওয়া গেছে। কিন্তু তেল নি:সরণের পর আক্রান্ত অঞ্চলে তা কমে মাত্র ১৬টি প্রজাতিতে এসেছে। বাকি ২৯টি প্রজাতির ফাইটো প্লানটন তেল আক্রান্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। এর ফলে পানির ভেতর প্রাথমিক খাদ্যস্তর ভেঙ্গে পড়েছে।
ফাইটো প্লানটনকে খাদ্য হিসেবে জো প্লানটন নিয়ে থাকে। সুন্দরবনের নদীর পানিতে ৮ প্রজাতির জো প্লানটন পাওয়া গেছে সাভাবিক অবস্থায়। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এখন মাত্র দুই প্রজাতির জো প্লানটন পাওয়া গেছে বাকি ছয়টি মারা গেছে। এর ফলে প্রাথমিক খাদ্য অনুচক্র ভেঙ্গে পড়েছে তেল নি:সারিত এলাকায়।
ব্যাঙের রেনু যা ব্যাঙাচি হিসেবে পরিচিত এরকম ছোট ৩৪টি বেনথস (BENTHOS) প্রজাতি সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া যায়। কিন্তু তেল নি:সরনের পর এ ধরনের মাত্র ৮টি প্রজাতি সেখানে পাওয়া গেছে বাকি ২৬টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
লবন পানির ওয়াটার লিলি
এ ধরনের জলজ উদ্ভিদ জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী স্থানে জন্মে থাকে। তেল নি:সরণের আগে এই অঞ্চলে ও তেল যেখানে যায়নি সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলে এ জলজ উদ্ভিদ প্রতি বর্গ মিটারে ১০ থেকে ১৪টি দেখা যেতো। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এ উদ্ভিদটি গোড়া পচে সবগুলোই মারা গেছে।
আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ব্যাপক ক্ষতি হবে
তেল নি:সরণের কারণে সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের বংশ বিস্তারের ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ তেল নি:সারিত আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ফল নস্ট হয়ে গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বর্গ মিটারে সুন্দরী গাছের ফল ৯ থেকে ১৪টি পাওয়া গেছে। তেল আক্রান্তের গবেষণা অঞ্চলের প্রাপ্ত সুন্দরী ফলের ৯৫ শতাংশের ভ্রুনই নস্ট হয়ে গেছে।
শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের ক্ষতিপ্রতি বর্গ মিটারের ৯৫ ভাগ শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের গায়ে তেলের কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। এর ফলে এ ধরনের উদ্ভিদের শ্বোষন ও শারিরীক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দুই শৈবালের জান শেষ
আক্রান্ত অঞ্চলে দুই ধরনের শৈবালের উপস্থিতি দেখা যেতো। এর মধ্যে লোহিত বা লাল শৈবাল হিসেবে পরিচিত উদ্ভিতের তিনটি প্রজাতি গাছের শেকড় ও শ্বাসমূলের সঙ্গে লেগে থাকতো। এরা বিভিন্ন জলজপ্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টির যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। আক্রান্ত অঞ্চলে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে।
এ ছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। বাদামি শৈবাল সাধারণত ছোট ছোট খালের পাশে জন্মায়।
মাছের ডিম ও রেনু পোনা শূণ্য
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে খোরশোলা ও পারসে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু হয়েছে। আর শ্যালা নদীতে তেল নি:সরণ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। মৎস্য প্রজনন মৌসুমে আক্রান্ত অঞ্চলের প্রতি লিটার পানিতে খোরশোলা, পারসে, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির ডিম ও রেনু পাওয়া যেতো ১৫'শ থেকে ২ হাজার। কিন্তু গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে এ অঞ্চলের পানিতে কোন ডিম ও রেনু পোনা নেই। উল্লেখ্য, পারসে, খোরশোলা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির পোনা কৃত্রিমভাবে হ্যাচারিতে তৈরী হয় না। এটা সুন্দরবন অঞ্চলে সব থেকে বেশি সংগ্রহ করা হয়।
মাডস্কিপার (Mudskippers)
সাভাবিক অবস্থায় মাডস্কিপার প্রতি বর্গ মিটারে পাওয়া যায় ৩ থেকে ৭টি। তেল নি:সরনের পর একটিও দেখা যায়নি। মাডস্কিপার মূলত পাখি, ভোদড়, সাপ, উদ বিড়াল (ফিশিং ক্যাট) এর খাদ্য।
কাকড়া
সুন্দরবন এলাকায় চার প্রজাতির কাকড়া দেখা যায়। প্রতি বর্গ মিটারে সুন্দরবনের সাভাবিক স্থানে কাকড়া দেখা যায় ৩ থেকে ৭টি। তবে গবেষণা এলাকায় কোন জীবিত দেখা যায়নি। তবে অসংখ্য মরা কাকড়া দেখা গেছে। কাকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য।
শামুক
সুন্দরবন এলাকায় ১০ প্রজাতির শামুক রয়েছে। গবেষণা সুন্দরবনে প্রতি বর্গ মিটারে ৯ থেকে ১৭টি শামুক দেখা যায়। তবে গবেষণা এলাকায় কোন জীবিত শামুক দেখা যায়নি। শামুক মাছ, পাখি ও কুমিরের খাদ্য।
কমেছে মাছের সংখ্যা
শ্যালা নদী ও আশপাশের আক্রান্ত অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। তেল নি:সরনের পর এই অঞ্চলের উপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ। বিভিন্ন ধরনের পাখি, উদ বিড়াল, কুমির ও ডলফিনের প্রধান খাদ্য মাছ।
কুমিরের ওপর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়বে
গবেষণার সময় তেল গায়ে লাগানো মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। অথচ সাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৩ থেকে ৬টি কুমির দেখা যায়।
পৃথিবীব্যাপী মহাসংকটপন্ন মাস্ক ফিনপুট দেখা মেলেনি
একামাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে হাঁস জাতীয় পাখি মাস্ক ফিনপুট প্রাণীটিকে কদাচিৎ দেখা যায়। সারা পৃথিবী মিলে এর সংখ্যা মাত্র ২ হাজার। আর সুন্দরবনে রয়েছে ২'শ মত। তেল নি:সরনের আগে ২০টি মাস্ক ফিনপুট পাখি দেখা গেছে। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষণা অঞ্চলের কোথাও এ পাখিটি গবেষকরা দেখতে পান নি।।
কমেছে পাখির বিচারনণ
মাছরাঙ্গা, বগসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে এ অঞ্চলে দেখা যেতো। তেল আক্রান্তের পর এ অঞ্চলে কোন মাছরাঙ্গা দেখতে পান নাই গবেষকরা। গবেষণাকালিন এ অঞ্চলে ১৭টি বগকে তেল মাখানো অবস্থায় দেখা গেছে।
শীতে এ অঞ্চলে পরীযায়ী বা অতিথী পাখির ঢল নামে। তবে তেল আক্রান্ত হবার পর কোন পরীযায়ী পাখি দেখা যায়নি।
ভোদর
আক্রান্ত অঞ্চলে দুটো মৃত ভোদড় দেখা গেছে। এ ছাড়া তেল গায়ে আরেকটি ভোদর ছাড়া আর ভোদর দেখা যায়নি। তবে গবেষণার আরেক অঞ্চল সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলে ভোদর দেখা গেছে। এই প্রাণীটি এক সময় মিটাপানিতেও দেখা যেতো। প্রাণিটি আইইউসিএনের তালিকা অনুযায়ী মহাসংকটপন্ন।
ডলফিন
তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোন ডলফিন গবেষকরা দেখেননি। অথচ সাভাবিকভাবে প্রতি ঘন্টায় ৫ থেকে ১০টি ডলফিনকে পানির উপর উঠতে দেখা যায়।
হরিণ
তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোন হরিণ দেখা যায় না। এমন কী এসব অঞ্চলে হরিণের সাম্প্রতিক কোন পায়ের ছাপও দেখা যায়নি।
পানির ওপর প্রভাব
পানির স্বচ্ছতা তেল নি:সরনের আগে ছিলো প্রতি লিটারে ২৩ থেকে ৩৯ সেন্টিমিটার। তেল নি:সরনের পর পানির স্বচ্ছতা কমে দাড়িয়েছে ৯ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার।
পানিতে বিভিন্ন ভাসমান দ্রব্য প্রতি লিটারে তেল নি:সরনের আগে ছিলো ৯ থেকে ১৫ মিলি গ্রাম। এখন সেটা প্রতি লিটার পানিতে ৩১৭ থেকে ১৬৮১ মিলি গ্রামে দাঁড়িয়েছে।
পশুর চ্যানেল তেল নি:সরনের আগে প্রতি লিটার পানিতে গড়ে তেল পাওয়া গেছে ৭ থেকে ৮ মিলি গ্রাম। আর তেল নি:সরনের পর তার পরিমান বেড়ে দাড়িয়েছে ২৯৫ থেকে ১৬৫০ মিলি গ্রাম। প্রতি লিটার পানিতে তেলের সর্বোচ্চ পরিমান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলো ১০ মিলি গ্রাম।
মাটিতে তেলের পরিমান
তেল আক্রান্ত অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে আগে যেখানে প্রতিকেজিতে তেলের উপস্থিতি ছিলো ২ থেকে ৪ মিলি গ্রাম। এখন সেখানে তেলের পরিমান প্রতি কেজিতে ৩৭০ থেকে ১৬৯০ মিলি গ্রাম।
এ ছাড়া গবেষণা এলাকায় দুই প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে ছয়টি মরা ব্যাঙ ও দুটি তেল আচ্ছাদিত ব্যাঙ পাওয়া গেছে। চারটি জলসাপ বা ডোরা সাপ মরা পাওয়া গেছে আর দুটি এ ধরনের সাপের গায়ে তেলের প্রলেপ দেখা গেছে। সুন্দরবন অঞ্চলে তিন প্রজাতির গুই শাপ রয়েছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার সাভাবিক অবস্থায় ২১ থেকে ২৭টি গুই শাপ দেখা গেলো আক্রান্ত দুটো গুই শাপ দেখা গেছে যা আবার তেলের প্রলেপ রয়েছে গায়ে। আর একটি গুই শাপ পাওয়া গেছে মৃত। একই অবস্থা বনমোরগের ক্ষেত্রে। আক্রান্ত অঞ্চলে কোন বনমোরগ দেখা যায়নি। আক্রান্ত অঞ্চলে কোন বন্য শুকর দেখা যায়নি। তবে এ অঞ্চলে সাভাবিক অবস্থায় শুকর দেখা যায়।
কী হবে সুন্দরবনের!
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, পানি, মাটি, উদ্ভিত ও প্রাণী গবেষণা দেখা গেছে, তেলের কারণে শ্যালা নদীসহ এর ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ছোট খালগুলোতে তেলের আস্তরণ পড়েছে। এসব তেল জোয়ারের সময় নদীর উপরিভাগে চলে এসেছে। এর ফলে নদীর উপরিভাগের বৃক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি এসব অঞ্চলে মাটিতে থাকা প্রাণী মারা যাবে। এ ছাড়া সব থেকে বড় ক্ষতি হবে কুমিরের। কারণ কুমির জোয়ারের পানি যেখানে গিয়ে ঠেকে ঠিক তার উপরই ঘর তৈরী করে ডিম পাড়ে। কুমিরের ডিমপাড়ার স্থান তেলের আস্তরণ থাকায় ডিম যদি কুমির সেখানে পাড়েও তাহলে বাচ্চা ফুটবে না। কুমির ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডলফিন। খাদ্যের অভাবে সে এই অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যাবে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর জানিয়েছেন, 'একটি বিষয় অন্যটির উপর নির্ভরশীল। যেহেতু খাদ্যচক্রেই বিশাল পরিবর্তন হবে সে কারণে এই খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল সকলপ্রানীই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুমির এখান থেকে অন্য স্থানে চলে যাবে। তবে প্রাণীদের মধ্যে যেতে মাইগ্রেট বা অভিবাসনে কনফ্লিক্ট বা সংঘাত বেশি হয় সে কারণে কুমির যদি অন্যস্থানে যায়ও তাহলে সেখানেও সংকটে পড়বে।' এই গবেষক আরো বলেন, ডলফিনও এ স্থান ত্যাগ করবে।
রামপাল কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে
শ্যালা নদীর এ নৌরুটটি বন্ধ করাই একমাত্র সমাধান নয় সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য। কোনভাবেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অন্য কোন রুট দিয়েও তেলের ট্যাংকার ও কয়লা পরিবহন করা যাবে না। তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকারক। যদি কয়লাবাহী কোন জাহাজ একবার সুন্দরবন অঞ্চলে ডুবে যায় তাহলে তার ক্ষতি কোনভবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
১. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মের লিংক
https://drive.google.com/file/d/0B9osZ5d29A8xQ3d2clVobmxXajQ/view?pli=1
২. গবেষণা কর্মের প্রাথমিক ফল নিয়ে প্রথম আলোর করা একটি প্রতিবেদন
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/401482/%E0%A6%AC%E0%A6%A8%...
৩. গবেষণাকর্মের চূড়ান্ত ফল নিয়ে কালের কণ্ঠে করা একটি প্রতিবেদন
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/12/27/168059
৪. এর আগে এ বিষয়ে আশঙ্কা করে লেখা আমার একটি ব্লগ
http://istishon.com/blog/1438
http://www.istishon.com/node/10469
কাউন্টার ফটোর আলোকচিত্রী রেজা শাহরিয়ার রহমানের এ ছবিটি ন্যাশনাল জিউগ্রাফি থেকে নেয়া।
ইহাতে সুন্দরবনের আসলে শীতকালে গা গরম হয়েছে। ইহাতে সুন্দরবনের কেন ওই নদীতেও কিছু হয়নি। বাঘ, হরিণ, কুমির, ডলফিনের ক্ষতিতো দুরের কথা, সুন্দরবনের তেল ডুবিতে কাকড়া-শামুকের ক্ষতি করতে পারেনি। সেইসব মানুষের জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটি নিঃসন্দেহে বড় ধরনের ধাক্কা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এই দুর্যোগে বিশাল কাজ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজটি করেছে সেটাই আসলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু আফসোস। আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক শব্দটি উপড়ে পেলে সেখানে করপোরেট স্বার্থ যুক্ত করে কাজ করা হচ্ছে। সেই আলাপ ও আলোচনা অন্য আরেকদিন করা যাবে। তবে তার আগে আসি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সুন্দরবনের উপর সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে। এই গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
প্রথম থেকেই বলছিলাম, খালি চোখে দেখা সম্ভব নয় আসলে সুন্দরবনে কি ঘটেছে এই তেল পড়ার পর। কারণ তেলের জটিল রাসায়নিক কী ঘটাতে পারে তা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য এ বিষয়ে লেখা আরেকটি ব্লগে সেই আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছিলাম।
শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফারনেস তেল ট্যাংকার ডুবে ছড়িয়ে পড়ে মহাসর্বনাশ ঘটিয়েছে সুন্দরবনের। ভারি এই তেলের কারণে নদী ও বনের প্রাণ প্রতিবেশ মারাÍক হুমকির মুখে পড়েছে। তেলের কারণে পানির ভেতর ডিম, রেনুপোনা, জলজপ্রাণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে। যার
ফলে এসবের উপর নির্ভরশীল, কুমির, ডলফিন, শুকর, হরিণসহ সুন্দরবনের গোটা জীব বৈচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এমন কী কুমির ও ডলফিন সুন্দরবনের তেল নি:সারিত অঞ্চল থেকে সরে যেতে পারে। ফারনেসের তেলের ক্ষতির প্রভাব সুন্দরবনের ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে তেল নি:সরনের পর তার প্রভাব সুন্দরবনে কি হতে পারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এ নিয়ে এক গবেষণায় এমন ভয়ঙ্কর ফল পাওয়া গেছে।এ বিষয়ে এ গবেষণার প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী আমাকে জানিয়েছেন, 'এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদি হবে। পানির অভ্যান্তরের পরিবর্তন ও তার ফলে বনের পশু পাখি ও গাছপালার উপর তার প্রভাব পড়বে।'
তিনি বলেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে বর্তমানের শ্যালা নদীর নৌ রুটটি বাতিল করতে হবে। এর পাশাপাশি কোনভাবেই সুন্দরবনের কোনস্থান দিয়েই তেলবাহী ও কয়লাবাহী কোন জাহাজ নেওয়া যাবেনা। তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকর। যদি কোন কয়লাবাহী জাহাজ এখানে ডুবে যায় তার ক্ষতি কোনভাবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না বলেও তিনি জানান।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল তেল নি:সরনের দিন থেকেই সুন্দরবনের ১২'শ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে তেলের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ টিমে অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক প্রসূন কুমার ঘোষ ও সহকারি অধ্যাপক আলী আকবর। এ ছাড়া সাতক্ষিরা শহীদ স্মৃতি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। এ টিমে অন্য সাতজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকায় তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি ৪৮ ঘন্টা পর পর এ গবেষণার তথ্য উপাত্য নেওয়া হয়েছে। ১২'শ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৫টি স্থান থেকে এ তথ্য গবেষণা নেওয়া হয়েছে। গত ১১, ১৩, ১৫, ১৭, ১৯, ২১, ২৩ ও ২৫ ডিসেম্বর মোট আট দিন এই গবেষণার জন্য তথ্য উপাত্য সংগ্রহ করা হয়েছে। একই সময় যেখানে তেল নি:সরণ হয়নি পশ্চিম সুন্দরবনের ঘড়িলাল, জোড়া সিং ও কলাগাছিয়াতে তথ্যা উপাত্য সংগ্রহ করা হয়। যেখানে তেল নি:সরণ হয়েছে সেই পূর্ব সুন্দরবন শ্যালা নদী ও তেল নি:সরণ হয়নি পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্যে এই তুলনায় করে গবেষণার ফল বেরা করা হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, তেল নি:সরনের ফলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্রে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদি। এ গবেষণাটির তত্বিয় মডেল নেওয়া হয়েছে আমেরিকান পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন (এপিএইচএ) এর দেওয়া মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এই গবেষক দলটি আগামি এক বছর সুন্দরবনের ওপর গবেষনা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন।
সুন্দরবনের ওপর বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে ৩০০ থেকে ৪০০টি উদ্ভিদকণা এবং ২০ থেকে ৩০টি প্রাণিকণা থাকে।
খুবির এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের এ গবেষণায় দেখা গেছে পানির অভ্যন্তরে ফারনেস তেলের কারণে এসব উদ্ভিদকনা ও প্রাণিকনার মারাÍক ক্ষতি হয়েছে। ফাইটো প্লানটন হলো জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক। সাভাবিক পরিবেশে পানিতে ৪৫টি প্রজাতির ফাইটো প্লানটন সুন্দরবনের নদীতে পাওয়া গেছে। কিন্তু তেল নি:সরণের পর আক্রান্ত অঞ্চলে তা কমে মাত্র ১৬টি প্রজাতিতে এসেছে। বাকি ২৯টি প্রজাতির ফাইটো প্লানটন তেল আক্রান্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। এর ফলে পানির ভেতর প্রাথমিক খাদ্যস্তর ভেঙ্গে পড়েছে।
ফাইটো প্লানটনকে খাদ্য হিসেবে জো প্লানটন নিয়ে থাকে। সুন্দরবনের নদীর পানিতে ৮ প্রজাতির জো প্লানটন পাওয়া গেছে সাভাবিক অবস্থায়। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এখন মাত্র দুই প্রজাতির জো প্লানটন পাওয়া গেছে বাকি ছয়টি মারা গেছে। এর ফলে প্রাথমিক খাদ্য অনুচক্র ভেঙ্গে পড়েছে তেল নি:সারিত এলাকায়।
ব্যাঙের রেনু যা ব্যাঙাচি হিসেবে পরিচিত এরকম ছোট ৩৪টি বেনথস (BENTHOS) প্রজাতি সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া যায়। কিন্তু তেল নি:সরনের পর এ ধরনের মাত্র ৮টি প্রজাতি সেখানে পাওয়া গেছে বাকি ২৬টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
লবন পানির ওয়াটার লিলি
এ ধরনের জলজ উদ্ভিদ জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী স্থানে জন্মে থাকে। তেল নি:সরণের আগে এই অঞ্চলে ও তেল যেখানে যায়নি সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলে এ জলজ উদ্ভিদ প্রতি বর্গ মিটারে ১০ থেকে ১৪টি দেখা যেতো। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এ উদ্ভিদটি গোড়া পচে সবগুলোই মারা গেছে।
আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ব্যাপক ক্ষতি হবে
তেল নি:সরণের কারণে সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের বংশ বিস্তারের ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ তেল নি:সারিত আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ফল নস্ট হয়ে গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বর্গ মিটারে সুন্দরী গাছের ফল ৯ থেকে ১৪টি পাওয়া গেছে। তেল আক্রান্তের গবেষণা অঞ্চলের প্রাপ্ত সুন্দরী ফলের ৯৫ শতাংশের ভ্রুনই নস্ট হয়ে গেছে।
শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের ক্ষতিপ্রতি বর্গ মিটারের ৯৫ ভাগ শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের গায়ে তেলের কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। এর ফলে এ ধরনের উদ্ভিদের শ্বোষন ও শারিরীক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দুই শৈবালের জান শেষ
আক্রান্ত অঞ্চলে দুই ধরনের শৈবালের উপস্থিতি দেখা যেতো। এর মধ্যে লোহিত বা লাল শৈবাল হিসেবে পরিচিত উদ্ভিতের তিনটি প্রজাতি গাছের শেকড় ও শ্বাসমূলের সঙ্গে লেগে থাকতো। এরা বিভিন্ন জলজপ্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টির যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। আক্রান্ত অঞ্চলে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে।
এ ছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। বাদামি শৈবাল সাধারণত ছোট ছোট খালের পাশে জন্মায়।
মাছের ডিম ও রেনু পোনা শূণ্য
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে খোরশোলা ও পারসে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু হয়েছে। আর শ্যালা নদীতে তেল নি:সরণ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। মৎস্য প্রজনন মৌসুমে আক্রান্ত অঞ্চলের প্রতি লিটার পানিতে খোরশোলা, পারসে, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির ডিম ও রেনু পাওয়া যেতো ১৫'শ থেকে ২ হাজার। কিন্তু গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে এ অঞ্চলের পানিতে কোন ডিম ও রেনু পোনা নেই। উল্লেখ্য, পারসে, খোরশোলা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির পোনা কৃত্রিমভাবে হ্যাচারিতে তৈরী হয় না। এটা সুন্দরবন অঞ্চলে সব থেকে বেশি সংগ্রহ করা হয়।
মাডস্কিপার (Mudskippers)
সাভাবিক অবস্থায় মাডস্কিপার প্রতি বর্গ মিটারে পাওয়া যায় ৩ থেকে ৭টি। তেল নি:সরনের পর একটিও দেখা যায়নি। মাডস্কিপার মূলত পাখি, ভোদড়, সাপ, উদ বিড়াল (ফিশিং ক্যাট) এর খাদ্য।
কাকড়া
সুন্দরবন এলাকায় চার প্রজাতির কাকড়া দেখা যায়। প্রতি বর্গ মিটারে সুন্দরবনের সাভাবিক স্থানে কাকড়া দেখা যায় ৩ থেকে ৭টি। তবে গবেষণা এলাকায় কোন জীবিত দেখা যায়নি। তবে অসংখ্য মরা কাকড়া দেখা গেছে। কাকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য।
শামুক
সুন্দরবন এলাকায় ১০ প্রজাতির শামুক রয়েছে। গবেষণা সুন্দরবনে প্রতি বর্গ মিটারে ৯ থেকে ১৭টি শামুক দেখা যায়। তবে গবেষণা এলাকায় কোন জীবিত শামুক দেখা যায়নি। শামুক মাছ, পাখি ও কুমিরের খাদ্য।
কমেছে মাছের সংখ্যা
শ্যালা নদী ও আশপাশের আক্রান্ত অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। তেল নি:সরনের পর এই অঞ্চলের উপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ। বিভিন্ন ধরনের পাখি, উদ বিড়াল, কুমির ও ডলফিনের প্রধান খাদ্য মাছ।
কুমিরের ওপর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়বে
গবেষণার সময় তেল গায়ে লাগানো মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। অথচ সাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৩ থেকে ৬টি কুমির দেখা যায়।
পৃথিবীব্যাপী মহাসংকটপন্ন মাস্ক ফিনপুট দেখা মেলেনি
একামাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে হাঁস জাতীয় পাখি মাস্ক ফিনপুট প্রাণীটিকে কদাচিৎ দেখা যায়। সারা পৃথিবী মিলে এর সংখ্যা মাত্র ২ হাজার। আর সুন্দরবনে রয়েছে ২'শ মত। তেল নি:সরনের আগে ২০টি মাস্ক ফিনপুট পাখি দেখা গেছে। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষণা অঞ্চলের কোথাও এ পাখিটি গবেষকরা দেখতে পান নি।।
কমেছে পাখির বিচারনণ
মাছরাঙ্গা, বগসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে এ অঞ্চলে দেখা যেতো। তেল আক্রান্তের পর এ অঞ্চলে কোন মাছরাঙ্গা দেখতে পান নাই গবেষকরা। গবেষণাকালিন এ অঞ্চলে ১৭টি বগকে তেল মাখানো অবস্থায় দেখা গেছে।
শীতে এ অঞ্চলে পরীযায়ী বা অতিথী পাখির ঢল নামে। তবে তেল আক্রান্ত হবার পর কোন পরীযায়ী পাখি দেখা যায়নি।
ভোদর
আক্রান্ত অঞ্চলে দুটো মৃত ভোদড় দেখা গেছে। এ ছাড়া তেল গায়ে আরেকটি ভোদর ছাড়া আর ভোদর দেখা যায়নি। তবে গবেষণার আরেক অঞ্চল সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলে ভোদর দেখা গেছে। এই প্রাণীটি এক সময় মিটাপানিতেও দেখা যেতো। প্রাণিটি আইইউসিএনের তালিকা অনুযায়ী মহাসংকটপন্ন।
ডলফিন
তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোন ডলফিন গবেষকরা দেখেননি। অথচ সাভাবিকভাবে প্রতি ঘন্টায় ৫ থেকে ১০টি ডলফিনকে পানির উপর উঠতে দেখা যায়।
হরিণ
তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোন হরিণ দেখা যায় না। এমন কী এসব অঞ্চলে হরিণের সাম্প্রতিক কোন পায়ের ছাপও দেখা যায়নি।
পানির ওপর প্রভাব
পানির স্বচ্ছতা তেল নি:সরনের আগে ছিলো প্রতি লিটারে ২৩ থেকে ৩৯ সেন্টিমিটার। তেল নি:সরনের পর পানির স্বচ্ছতা কমে দাড়িয়েছে ৯ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার।
পানিতে বিভিন্ন ভাসমান দ্রব্য প্রতি লিটারে তেল নি:সরনের আগে ছিলো ৯ থেকে ১৫ মিলি গ্রাম। এখন সেটা প্রতি লিটার পানিতে ৩১৭ থেকে ১৬৮১ মিলি গ্রামে দাঁড়িয়েছে।
পশুর চ্যানেল তেল নি:সরনের আগে প্রতি লিটার পানিতে গড়ে তেল পাওয়া গেছে ৭ থেকে ৮ মিলি গ্রাম। আর তেল নি:সরনের পর তার পরিমান বেড়ে দাড়িয়েছে ২৯৫ থেকে ১৬৫০ মিলি গ্রাম। প্রতি লিটার পানিতে তেলের সর্বোচ্চ পরিমান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলো ১০ মিলি গ্রাম।
মাটিতে তেলের পরিমান
তেল আক্রান্ত অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে আগে যেখানে প্রতিকেজিতে তেলের উপস্থিতি ছিলো ২ থেকে ৪ মিলি গ্রাম। এখন সেখানে তেলের পরিমান প্রতি কেজিতে ৩৭০ থেকে ১৬৯০ মিলি গ্রাম।
এ ছাড়া গবেষণা এলাকায় দুই প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে ছয়টি মরা ব্যাঙ ও দুটি তেল আচ্ছাদিত ব্যাঙ পাওয়া গেছে। চারটি জলসাপ বা ডোরা সাপ মরা পাওয়া গেছে আর দুটি এ ধরনের সাপের গায়ে তেলের প্রলেপ দেখা গেছে। সুন্দরবন অঞ্চলে তিন প্রজাতির গুই শাপ রয়েছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার সাভাবিক অবস্থায় ২১ থেকে ২৭টি গুই শাপ দেখা গেলো আক্রান্ত দুটো গুই শাপ দেখা গেছে যা আবার তেলের প্রলেপ রয়েছে গায়ে। আর একটি গুই শাপ পাওয়া গেছে মৃত। একই অবস্থা বনমোরগের ক্ষেত্রে। আক্রান্ত অঞ্চলে কোন বনমোরগ দেখা যায়নি। আক্রান্ত অঞ্চলে কোন বন্য শুকর দেখা যায়নি। তবে এ অঞ্চলে সাভাবিক অবস্থায় শুকর দেখা যায়।
কী হবে সুন্দরবনের!
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, পানি, মাটি, উদ্ভিত ও প্রাণী গবেষণা দেখা গেছে, তেলের কারণে শ্যালা নদীসহ এর ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ছোট খালগুলোতে তেলের আস্তরণ পড়েছে। এসব তেল জোয়ারের সময় নদীর উপরিভাগে চলে এসেছে। এর ফলে নদীর উপরিভাগের বৃক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি এসব অঞ্চলে মাটিতে থাকা প্রাণী মারা যাবে। এ ছাড়া সব থেকে বড় ক্ষতি হবে কুমিরের। কারণ কুমির জোয়ারের পানি যেখানে গিয়ে ঠেকে ঠিক তার উপরই ঘর তৈরী করে ডিম পাড়ে। কুমিরের ডিমপাড়ার স্থান তেলের আস্তরণ থাকায় ডিম যদি কুমির সেখানে পাড়েও তাহলে বাচ্চা ফুটবে না। কুমির ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডলফিন। খাদ্যের অভাবে সে এই অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যাবে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর জানিয়েছেন, 'একটি বিষয় অন্যটির উপর নির্ভরশীল। যেহেতু খাদ্যচক্রেই বিশাল পরিবর্তন হবে সে কারণে এই খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল সকলপ্রানীই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুমির এখান থেকে অন্য স্থানে চলে যাবে। তবে প্রাণীদের মধ্যে যেতে মাইগ্রেট বা অভিবাসনে কনফ্লিক্ট বা সংঘাত বেশি হয় সে কারণে কুমির যদি অন্যস্থানে যায়ও তাহলে সেখানেও সংকটে পড়বে।' এই গবেষক আরো বলেন, ডলফিনও এ স্থান ত্যাগ করবে।
রামপাল কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে
শ্যালা নদীর এ নৌরুটটি বন্ধ করাই একমাত্র সমাধান নয় সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য। কোনভাবেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অন্য কোন রুট দিয়েও তেলের ট্যাংকার ও কয়লা পরিবহন করা যাবে না। তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকারক। যদি কয়লাবাহী কোন জাহাজ একবার সুন্দরবন অঞ্চলে ডুবে যায় তাহলে তার ক্ষতি কোনভবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
এ কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। যদি ধরেও নেই রামপাল কেন্দ্র থেকে ক্ষতিকর কিছু বের হবে না, শুধু গোলাপজল ও 'পবিত্র অক্সিজেন' বের হবে তবুও এই কেন্দ্রের জন্য যে কয়লা আনা হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তা যদি একবার ডুবে যায়? তাহলে শুধু ভয়ঙ্কর বললেই কাজ হবে না, সুন্দরবন রক্ষা করার জন্য তখন সুলতানা রহমানকে দিয়ে ট্রিবিউনে লিখলেও কিন্তু মাপ পাওয়া যাবে না।তথ্য সূত্র :
১. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মের লিংক
https://drive.google.com/file/d/0B9osZ5d29A8xQ3d2clVobmxXajQ/view?pli=1
২. গবেষণা কর্মের প্রাথমিক ফল নিয়ে প্রথম আলোর করা একটি প্রতিবেদন
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/401482/%E0%A6%AC%E0%A6%A8%...
৩. গবেষণাকর্মের চূড়ান্ত ফল নিয়ে কালের কণ্ঠে করা একটি প্রতিবেদন
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/12/27/168059
৪. এর আগে এ বিষয়ে আশঙ্কা করে লেখা আমার একটি ব্লগ
http://istishon.com/blog/1438
http://www.istishon.com/node/10469
__._,_.___
No comments:
Post a Comment