Wednesday, April 17, 2013

ছিল রুমাল, হল বেড়াল ‘পাল্টি’ নামের অলীক কুনাট্য

ছিল রুমাল, হল বেড়াল 'পাল্টি' নামের অলীক কুনাট্য

ছিল রুমাল, হল বেড়াল 'পাল্টি' নামের অলীক কুনাট্য
ইতিহাস। নন্দীগ্রাম-পরবর্তী অধ্যায়ে বিদ্বজ্জনদের মিছিল। কলকাতা।---শুভ্রজিত চন্দ্র।
সুমন চট্টোপাধ্যায়

ভালো কথায় বলে বোধহয় ভোল-বদল৷ চ্যাংড়ারা বলে পাল্টি খাওয়া৷ 

ইদানীং এ শহরে এত লোক এত কারণে এত রকম ভাবে পাল্টি খাচ্ছে যে চোখে রীতিমতো সর্ষে-ফুল দেখছি৷ কাল কী দেখেছিলাম বা পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম তার সঙ্গে আজ কী দেখছি বা পড়ছি বা শুনছি বা আগামীকাল কী দেখতে পারি বা পড়তে পারি বা শুনতে পারি তার হিসেব মেলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যেতে হচ্ছে৷ সকালে যে ছিল রুমাল, সন্ধ্যায় তাকে দেখছি বেড়াল হয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে৷ ইদানীং যাঁর হম্বিতম্বি দেখে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় বাংলার বাঘ বলে ঠাওর হত, হঠাত্ শোনা গেল, পরবাসে কে যেন তাঁকে ফের জাদুমন্ত্রে বশ করে মূষিক-তনয়ে পর্যবসিত করে ফেলেছে৷ মাথায় টুপি আর হাতে চওড়া বালা পড়ে যে শিল্পী মহোদয় ফি-সন্ধেয় রানিমা'র বন্দনায় স্টুডিয়ো মুখর করে তুলতেন, বিবেকের দংশন আর সহ্য করতে না পেরে তিনি চ্যানেল-পাল্টি খেয়েছেন৷ পরাজিত ও প্রত্যাখ্যাত মুখ্যমন্ত্রীর আদি-অকৃত্রিম গুণগ্রাহী এবং তাঁর দলের প্রায়-কমরেড হিসেবে যাঁর পরিচয় মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, দিন কয়েক আগে সেই বলশালী সঙ্গীতশিল্পীকে দেখা গেল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নিগ্রহের প্রতিবাদ জানাতে নিজে মাইক ধরেছেন এবং বেশ কয়েকজন নামী-দামি, নানা বয়সের সতীর্থ জোগাড় করে তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে মাটিতে চাটাইয়ের উপর বসিয়ে দিয়েছেন৷ পাল্টা-পাল্টি খাওয়ার এমন নিত্য নতুন রঙ্গই এখন স্বভাব-বিমর্ষ বঙ্গবাসীর সর্বোত্কৃষ্ট বিনোদন৷ আইপিএল-এর চেয়েও বড়ো৷ 

পাল্টিবাজ হিসেবে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের সুখ্যাতির কোনও জুড়ি নেই৷ দেশে দলত্যাগ বিরোধী আইন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত এদের আয়ারাম-গয়ারাম বলে ডাকা হত৷ দু'টি নির্বাচনের মাঝখানে এঁরা বারে বারে দল বদল করতেন, যে বেশি দর হাঁকত তাঁর কাছেই চলে যেতেন অথচ নির্বাচিত পদটি খোয়াতে হত না৷ কোয়ালিশনের মুষল পর্ব চালু হওয়া ইস্তক পাল্টিবাজিটা হয় প্রধানত বিজেপি আর কংগ্রেসকে ঘিরে৷ এই নির্বাচনে যিনি এনডিএ-র সঙ্গী, পরের নির্বাচনে তাঁকেই দেখা যেতে পারে ইউপিএ-র শিবিরে৷ আবার উল্টেটাও হতে পারে, হয়েই থাকে৷ ক্ষমতার রাজনীতির ভিত্তিটাই হল তাত্ক্ষণিকতা৷ ঠিক এই মুহূর্তে কার সঙ্গে থাকলে আমার সবচেয়ে বেশি লাভ সেটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতার রাজনীতির চালিকাশক্তি৷ বামপন্থীরা সহ এদেশে হেন কোনও রাজনৈতিক দল নেই যারা এই নিয়মের ব্যতিক্রম৷ দু'জন অদ্ভুত শয্যাসঙ্গী একই বিছানায় রাত্রিবাস করবে এই দুর্লভ ব্যাপারটায় প্রায় একচেটিয়া অধিকার রাজনীতির কারবারিদেরই৷ দ্বিতীয় স্থানে আছে ব্যবসায়ীকুল৷ জোর যার মুলুক তার নয়, ক্ষমতা যাঁর আমি তাঁরই৷ ক্ষমতায় গঙ্গা বসলে ব্যবসায়ী গঙ্গাদাস, যমুনা বসলে যমুনাদাস, হরি বসলে হরিদাস, বুদ্ধ বসলে বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণী বসলে বেম্মদত্যি৷ ফলে এ রাজ্যের এক প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর জমানায় এ শহরের যে সব ব্যবসায়ীকে তাঁর সরকারি বাসভবনে দু'বেলা ডিউটি করতে দেখা যেত, তাঁদের অনেকেই এখন নতুন মুখ্যমন্ত্রীর জয়গানের স্বরলিপি মুখস্থ করে ফেলেছেন৷ রাজানুগ্রহ না পান, রাজ-রোষের বেমক্কা বলি যাতে না হতে হয় সেজন্য তাঁরা শহরে পদধূলি দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে চলেন৷ যাঁরা এখনও এত দূর অগ্রসর হতে পারেননি, ব্যর্থতার গ্লানি তাঁদের কাউকে কাউকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ কোন পান্ডাকে ধরলে বিগ্রহের কাছে যাওয়ার রাস্তাটা তুলনায় মসৃণ হয় সেই অনুসন্ধান চালিয়ে চালিয়ে তাঁরা কেউ কেউ, ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়েও পড়েছেন বলে খবর৷ বাম জমানার অবসানে হঠাত্ বিধি বাম হয়ে ওঠার কারণে তাঁদের শুকনো মুখগুলি দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়৷ 

এটা ব্যবসায়ীদের মজবুরি৷ অনিবার্য ভবিতব্য৷ জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার ধৃষ্টতা কোনও কালিদাস ব্যবসায়ীও সচরাচর দেখান না, দেখাতে পারেন না৷ উচ্চাকাঙ্খী ব্যবসায়ীরা তো আদৌ নন৷ সংস্কারের ঢক্কানিনাদ যতই বাজানো হোক, দু'দশক পরে আজও এদেশে সরকার বা নানাবিধ সরকারি বা আধা-সরকারি সংস্থার নিয়ম-কানুনকে এড়িয়ে কোথাও কোনও ব্যবসা করার উপায়ই নেই৷ এমনকী সামান্য একটি বাড়ি তৈরিও সম্ভব নয়৷ সেই নিয়ম-কানুনের রশি যাদের হাতে তাদের চক্ষুশূল হয়ে পড়াটা আত্মহত্যারই সামিল৷ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ভোটের আগে বিরোধীপক্ষের এক নেতাকে সামান্য অর্থ সাহায্য করার জন্য তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী এ শহরের এক অনুগত ব্যবসায়ীর উপর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন৷ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সেই ব্যবসায়ীর তখন রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল৷ নতুন জমানায় তেমন দুরবস্থা একেবারে কারও হয়নি বা হচ্ছে না সেকথাও জোর দিয়ে বলা যায় কি? কলকাতার ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড়ো অসুবিধে হল কী ভাবে পাল্টি খেতে হয় চৌত্রিশ বছরের অনভ্যাসের কারণে তাঁরা সে কথা মোটামুটি ভুলেই গিয়েছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে যাঁরা বড় প্লেয়ার এবং কুশলী তাঁরা চট করে নিজেদের রন্ত করে নিয়েছেন৷ যাঁরা ততটা নন তাঁরা পিছিয়ে পড়ে এখনও অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন৷ 

তবে এই মুহূর্তে শহর কলকাতায় চোখে পড়ার মতো পাল্টিবাজি করছেন শিল্পী-সাহিত্যিক-কলাকুশলীরাই৷ কেন যাচ্ছে, যারপরনাই সংক্ষেপে তা ব্যাখ্যা করা যাক৷ রাজনৈতিক ক্ষমতার মতো এ রাজ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের উপরেও বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল কার্যত একচেটিয়া৷ বলতে গেলে এটাই ছিল পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ঐতিহ্য, বুদ্ধিজীবী বা আঁতেল মানেই বামপন্থী৷ সংস্কৃতি বা মননশীলতার জগতে বিচরণকারীরা কংগ্রেসি বা তৃণমূল কংগ্রেসি হবেন এ রাজ্যে এটা ভাবতে পারাই যেত না৷ দলের প্রতি বামপন্থী সংস্কৃতিজীবীদের আনুগত্যও ছিল একেবারে প্রশ্নাতীত, সম্পূর্ণ হোলটাইমারদের মতোই৷ কিউবার আবহাওয়া থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কারণে নিকারাগুয়ায় আলুচাষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সব বিষয়েই আলিমুদ্দিনের প্রচারপত্রে এদের নাম ও স্বাক্ষর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশিত হত৷ যাঁরা কার্ড হোল্ডারদের মতো আচরণ করতেন না তাঁদেরও সমর্থন কোন দিকে সেটা বুঝতে কারও কোনও অসুবিধে হত না৷ 

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম যেমন এ রাজ্যে বামেদের গ্রামের ভিত প্রায় ধসিয়ে দিয়েছে অনেকটা তেমন ভাবে ধস নেমেছে তাদের অনুগামী সংস্কতির জগতেও৷ নতুন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলয়ে এখন যাঁদের নিত্যি চলাফেরা সামান্য দু'একটি ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের প্রায় সবাই বামপন্থী, কেউ গাঢ়, কেউ ফিকে৷ কেউ এই সেদিন পর্যন্ত সিপিএম সাংসদদের ব্যাগ বইতেন, কেউ সিপিএম নেতার গানের জলসা মাতাতেন, কেউ আবার বামপন্থী তার্কিক বা নাট্যকর্মী হিসেবে মঞ্চ আলো করে রাখতেন৷ নতুন সরকারের দু'বছরের মাথায় এঁদের কারও কারও মধ্যে আবার চিত্ত-চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ অন্যদিকে দেরিতে হলেও জার্সি বদলে এখন সরকারি শিবিরে দেখা যাচ্ছে পরিচিত বামপন্থী মুখকে৷ তাঁরা হাসিহাসি মুখে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে নতজানু হয়ে পুরস্কার নিচ্ছেন, গান গাইছেন, মিটিং মিছিলও করছেন৷ কেউ কেউ আবার বছরের পর বছর পুরস্কার পেয়ে গিনেস বুক অব রেকর্ডে নাম তোলার পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন৷ 

রাজ্য রাজনীতির ওই টালমাটাল দিনগুলিতে কারা এসেছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শিবিরে বা তাঁর দিকে ঝুঁকেছিলেন? এই দলে একটি ক্ষুদ্র অংশ আছেন কোথাও যাঁদের বেশিদিন মন টেকে না, বলা যায় এঁরা স্বভাব-বিক্ষুব্ধ৷ এঁদের মধ্যে একজন যেমন গানওয়ালা সাংসদ আছেন তেমনই একজন প্রবীণ মাস্টারমশাইও আছেন৷ দ্বিতীয় অংশে আছেন তাঁরা যাঁদের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর উপর সত্যিই আস্থা আছে, তাঁর নেতৃত্বে বাংলায় ভালো কিছু হবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস৷ তৃতীয় অংশটি সুবিধাবাদী এবং এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ এঁদের বেশিরভাগ বিবিধ সরকারি সুযোগ সুবিধা নেন, পদ অলংকৃত করেন কিন্ত্ত প্রকাশ্যে এসে নতুন জমানার সমর্থনে দাঁড়াতে এক ধরনের বামপন্থী শুচিবায়ুগ্রস্ততায় ভোগেন৷ চর্মরোগের মতো এঁরা নতুন মুখ্যমন্ত্রীর সান্নিধ্য আড়াল করে রাখতে চান ক্রমাগত৷ এঁদের বাইরে আছেন একমাত্র এক প্রবীণা যশস্বী লেখিকা যিনি কখন কোথায় আছেন নিজেও ভালো করে বুঝতে পারেন না, হাতের লেখা পড়ে সরকারকে সমর্থন করে মুখের কথায় ফের বিরোধিতা করেন৷ 

বাম শিবির ছেড়ে এখনও যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একের পর এক কলাকুশলী তাঁর দিকে আসছেন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তা অবশ্যই শ্লাঘার কথা৷ এর থেকে প্রমাণিত হয় তাঁদের অনুগামীরাও সহসা সিপিএমের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না, বরং অভ্যস্ত রাজানুগ্রহ না পেয়ে তাঁরা ক্রমশ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে শুরু করে দিয়েছেন৷ প্রথমে পঞ্চায়েত তারপরে লোকসভার ভোটে বামেদের ফের বিপর্যয় হলে হয়তো আরও অনেককে দেখা যাবে শরণার্থী শিবিরে৷ আবার উল্টোটা হলে মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারবেন সুবিধেবাদী বামের পিরিত কত বড়ো বালির বাঁধ৷ 

পাল্টিবাজি ভালো না মন্দ, সে প্রশ্ন অনর্থক৷ না পাল্টানোটাই মনুষ্য চরিত্র বিরোধী, হয়তো জীবনেরও বিরোধী৷ সে ভাবেই বিষয়টিকে দেখা ও মেনে নেওয়া ভালো৷ যাঁদের কল্পনাশক্তি আছে তাঁরা তো পাল্টাবেনই৷ ওই যে একদা এক বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক বলেছিলেন না, 'দ্য ওনলি কমপ্লিট কনসিসটেন্ট পিপল আর দ্য ডেড?'

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcom

Website counter

Census 2010

Followers

Blog Archive

Contributors